আত্মসম্মান [Bangla Story]

আত্মসম্মান হচ্ছে মানুষের মেরুদণ্ডের মত, যেটি ছাড়া মানুষকে মানুষ বলা যায় না! কাজের মেয়ে জয়তুন নিহার সাহেবের বাসায় কাজ করছে প্রায় চার বছর ধরে। জয়তুনের পরিবার গরীব হতে পারে কিন্তু তার আত্মসম্মান বোধ এতই বেশী যে শিক্ষিত নিহারও অবাক না হয়ে পারে না!

 

নিহারের মন মানসিকতার সাথে জয়তুনের মানসিকতা অনেকাংশেই মিলে যায় বিশেষ করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার বিষয়ে। নিহার নিজে যেমন অন্যায় করে না, তেমনি সে অন্যায় সহ্যও করতে পারে না। জয়তুনের মধ্যেও একই ধরণের বৈশিষ্ট বিদ্যমান।

 

নিহার একটি কলেজে চাকরী পেয়েছে বলেই আগে যে বাসায় থাকত তা ছেড়ে দিয়ে কলেজের পাশেই একটি বাসা নিয়েছে। বাসা নেবার পূর্বে বাড়িওয়ালা তাজ মিয়া কথা দিয়েছে যে বাড়িতে উঠার আগেই প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে রং করে দেবে এবং বাসার ভেতরে যাবতীয় নষ্ট সুইচ, কারেন্টের লাইনে কোনও সমস্যা ইত্যাদিও ঠিক করে দেয়া হবে।

 

কিন্তু নতুন বাসায় উঠার পরে নিহার বুঝতে পারে যে বাড়িওয়ালা তার দেয়া কোনও কথাই রাখেনি। সে রীতিমত বেইমানীই করেছে তার সাথে। যাইহোক, নিহার এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তাজ আমতা আমতা করে বলে, আসলে ব্যস্ততায় কাজগুলো করা হয়ে উঠেনি। তবে পরে করে দেয়া হবে

 

নিহারের আ বোঝার বাকী থাকে না যে তাজ কেমন ধুরন্ধর আর মিথ্যাবাদী প্রকৃতির মানুষ, অনেকটা দ্যা মার্চেন্ট অব ভেনিস-এর শাইলকের মত! যাইহোক, নতুন জায়গায় নতুন এবং বিশ্বস্ত কাজের লোক পাওয়া খুবই দুষ্কর। ইতোমধ্যে জয়তুন ঘরের মালপত্র কিছুটা গুছিয়ে দিতে এসেছে। জয়তুনের বাসা অনেক দূরে হওয়াতে সে নিহারকে অনুরোধ জানায় যাতে নতুন কোনও কাজের লোক রাখে। কিন্তু নিহার তাকে উল্টো অনুরোধ করে যেন সেই এখানে এসে আগের মতই ঘরের কাজ করে। নিহার আশ্বাস দেয় যে তার মাসিক বেতনও কিছুটা বাড়িয়ে দেয়া হবে। শেষপর্যন্ত জয়তুন আর না বলতে পারে না।

 

জয়তুন আগের মতই তার কাজ ঠিকমত করতে থাকে। সে ভদ্রভাবে আসে এবং ভদ্রভাবেই চলে যায়। কখনও কারো সাথে উচ্চবাচ্য করা বা অভদ্র আচরণ করা তার স্বভাবে নেই। সে যেন ক্লাসের বাধ্য ছাত্রীটির মতই যে নীরবে তার স্যারের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলে।

 

কিন্তু আগ্নেয়গিরির নীরবতাকে যদি কেউ দুর্বলতা ভাবে তবে সে আহম্মক নাম্বার ওয়ান! সময় হলে আগ্নেয়গিরি যেমন হুংকার দিয়ে উঠে, নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয়, ঠিক একইভাবে জয়তুনও তার বিরুদ্ধে কেউ অন্যায় করলে সহজে ছেড়ে কথা বলে না। তার সাধ্যে যতটুকু কুলায় প্রতিবাদ সে করবেই।

 

একদিন বাসায় কি একটা মশলা না থাকাতে নিহারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জয়তুন পাশের দোকানে সেটি কিনতে যায়। যাবার সময় একটু অসতর্কতামূলকভাবে দরজাটি একটু শব্দ করে বন্ধ হয়। মশলা কিনে ফেরার সময় বারিওয়ালা তাজ ক্রুদ্ধভাবে জয়তুনকে থামায় এবং বলে,

 

- এতো জোরে দরজা লাগাও কেন?

- জয়তুন ভদ্রভাবেই বলে যে কেউ তো আর ইচ্ছে করে এভাবে দরজা লাগায় না; তাছাড়া আমিতো আর বাচ্চা নই যে এমনটি প্রতিদিন হয়!

- তখন তাজ খানিকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে যে তুমি প্রতিদিন এমন করে দরজা লাগাও

- তখন জয়তুন আঘাতপ্রাপ্ত গোখরা সাপের মত ফোঁস করে উঠে বলে, আর কোনদিন এভাবে দরজা লাগানোর সময় আওয়াজ হয়েছে বলেন?

- তখন তাজ আরও রাগান্বিত হয়ে বলে, আর কথা বাড়িয়ো না যাও 

 

তাজ আশা করেনি যে একটি কাজের মেয়ের এতোটা তেজ থাকবে; তার ধারণা ছিল যে জয়তুনকে যা ইচ্ছা বলবে এবং সে গাধার মত তাই শুনে যাবে! কিন্তু হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান নয়, তেমনি সব মানুষও সমান নয়। পৃথিবীতে মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন আছে, তেমনি মেরুদণ্ডযুক্ত মানুষও আছে!

 

তাজের এ অন্যায় আচরণ এবং ব্যবহারে জয়তুন খুব ব্যথিত হয়েছে। সে নিহারকে আদ্যোপান্ত জানানোর পর নিহারও বুঝতে পারে যে এখানে জয়তুনকে দোষারোপ করার মত কিছুই ঘটেনি। দরজা একটু সামান্য জোরে লাগার ফলে একজন মানুষকে এভাবে যাচ্ছেতাই বলাটা কখনও সভ্য সমাজের অংশ হতে পারে না।     

 

নিহারও বেশ গম্ভীরভাবেই নিয়েছে বিষয়টি। সে তাজকে ফোন দিয়ে ব্যাপারটা সম্পর্কে একটু আলাপ করতে চায়। তাজ নিজের দোষ স্বীকার না করে সমানে জয়তুনকে দোষ দিতে থাকে। তার কথায় মনে হয় যেন সমাজের সকল অপরাধ এবং দোষ শুধুমাত্র গরীবরাই করে; সচ্ছলরা একেবারে ধোঁয়া তুলসীপাতা!

 

নিহার ভদ্রভাবেই জানতে চায় যে কেন প্রতিদিন এভাবে জোরে দরজা লাগায় এ কথাটি বলা হল। এ কথা শোনার পর তাজ অস্বীকার করে যে এমনভাবে নাকি বলেনি। তাজ আবারও জোর দিয়েই বলে যে এমন কথা বলা হয়েছে, তখন সে স্বীকার করে যে বলেছে।

 

যাইহোক, নিহার বুঝতে পারে যে তাজের মত অভদ্র মানুষের সাথে বেশীক্ষণ আলাপ চালিয়ে যাওয়া আর উলুবনে মুক্তা ছড়ানো একই কথা। সে কথোপকথনটির ইতি টেনে জয়তুনকে সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে সে কোনও অন্যায় করেনি, তার শুধুশুধু মনঃকষ্টে ভোগার কারণ নেই। সাথে সাথে ফোন করে জিজ্ঞেস করাটাই একধরণের প্রতিবাদ যা নিহার করেছে শুধুমাত্র অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দৃষ্টিকোণ থেকে।

 

নিহারের কথায় দুঃখী জয়তুনের মনের কষ্ট হয়তো কিছুটা লাঘব হয়েছে। পরদিন সন্ধ্যায় যে ঘটনাটি ঘটে তার জন্য নিহার মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তাজ নিহারকে ফোন করে বলে যে সে যাতে জয়তুনকে বাসায় আসতে নিষেধ করে; যদি সে আসে, তবে তাকে গেইটে আটকানো হবে; ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।

 

এ কথা শুনে নিহারের মনে হয়েছে যে আসলে সে কোন দুনিয়ায় আছে, আদিম যুগে নেইতো! সামান্য একটা ঘটনাকে টেনেহিঁচড়ে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! নিহার এখন প্রতিবাদে কণ্ঠে জানতে চায় এর পেছনের কারণটি কি। তখন তাজ বলে যে জয়তুনের স্বভাব নাকি ভালো না।

 

নিহারের আর বুঝতে বাকী থাকে না যে এ শুধুমাত্র তাজের অহেতুক অহংকার এবং শিশুসুলভ জেদের বহিঃপ্রকাশ। যেহেতু জয়তুন নিহারের বাসায় কাজ করে, তাই তাকে আসতে নিষেধ করার অধিকার শুধু নিহারেরই থাকার কথা। বাড়িওয়ালাও ক্ষেত্র বিশেষে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে তবে তার পেছনে দৃঢ় যুক্তি থাকা আবশ্যক। কিন্তু এখানে নিহার কোনও যুক্তি দেখতে পাচ্ছে না; এককথায় এটি ঘোরতর অন্যায়।

 

জয়তুনকে আসতে নিষেধ করা মানে নিহারের আত্মসম্মানেও একপ্রকার তীব্র আঘাত! তাকে আসতে বারণ করার কথা বলা নিহারের পক্ষে কখনই সম্ভব নয় কারণ সে তো অন্যায় কিছু করেনি। তাজ যেটি করছে সেটি বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

নিহার তাজকে জানিয়ে দিয়েছে যে সে জয়তুনকে আসতে নিষেধ করতে পারবে না। সে বাড়ি ছেড়ে দেবে; বাড়ি খোঁজার জন্য সে কিছুদিন সময় চেয়েছে। জয়তুন নিহারকে আগে যতটুকু শ্রদ্ধার চোখে দেখত, এখন তার প্রতি সম্মান ও ভক্তি যেন হাজার গুণে বেড়ে গেছে। এমন অবস্থায় নিহারের স্থানে অন্য কেউ হলে হয়তো তাজের কথামত জয়তুনকে নিষেধ করে অন্য কাউকে রাখতো, কিন্তু নিহার দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি-র সেই অদম্য এবং অবিচল স্যাণ্টিয়াগোর মত ভাঙবে তবু মচকাবে না!

 

      পরদিন নিহার বাসা খুঁজতে শুরু করে; অচিরেই নতুন বাসায় উঠতে পারবে বলে তার বিশ্বাস।   

View kingofwords's Full Portfolio
tags: