ক্লেদাক্ত দ্বৈতসত্ত্বা

দরজায় একনাগাড়ে কড়া নাড়ার আওয়াজ হয়েই যাচ্ছে। বিরক্তিকর খটখট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল সালেহা বেগমের। অসুস্থ শরীর নিয়ে বেচারিকে এই পৌষের ভোরে উঠতে হচ্ছে। কাল রাতেও জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিলো। পাশেই ভোস ভোস শব্দে নাক ডেকে, মোটা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিল তার স্বামী বিরুইপাড়া থানার ওসি শমসের মোল্লা। সারারাত সালেহা ছটফট করেছে কিন্তু স্বামী একবারের জন্য গায়ে হাত দিয়ে দেখেনি জ্বর কতখানি। কিছু লাগবে কিনা। বন্ধ্যা বলে কোনদিন স্বামীর সামান্য সহানুভুতিও পায় নি সে। হয় নয় কথায় শমসের মোল্লা তাকে বাঁজা মেয়েমানুষ বলে খোঁটা দিতে কার্পন্য করে না। মুখ বুঝে সহ্য করে যায় সালেহা। স্বামীর সোহাগ কখনও পায় নি, আশাও করে না। সন্তান জন্ম দিতে না পারার কষ্ট একটা মেয়ের যে কতখানি তা পুরুষজাতকে বোঝানো যাবে না কখনই। অত্যাচার সইতে না পেরে কতবার স্বামীকে বলেছে আবার বিয়ে করতে। কে শোনে কার কথা। বিনা পয়সার চাকর সালেহার চেয়ে ভাল আর কে হবে? আর স্ত্রী’র প্রয়োজন? শারীরিক চাহিদা অন্য কারো কাছ থেকে পুরণ হলেই বা সালেহার কি? অসহায় সালেহার যাবার জায়গা নেই কোথাও। শত অপমানের মুখেও মাটি কামড়ে পড়ে আছে স্বামীর ভিটায়।

খাটের থেকে নামার পর সালেহার মনে হল মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি খাটে মশারি টাঙ্গানোর একটা খুঁটি ধরে নিজেকে সামলে নেয়। আলনা থাকে শালটা কোন রকমে গায়ে চাপিয়ে ছিটকানি খুলে। এত কুয়াশা বাইরে রে আধা হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। ভীষণ শীত পড়েছে এবার। জ্বর শরীরে সালেহার পা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। খুক খুক করে কাশির শব্দ শুনতে পায় সে। কিন্তু মানুষটাকে দেখতে পায় না।
-কে কে? নিজের গলার স্বর নিজের কাছেই অপরিচিত লাগে সালেহার।
-খালাম্মা আমি। বলে কুয়াশার ভেতর থেকে আবির্ভুত হয় মনু গাছি।
-মনু তুই?
-হ খালাম্মা। খেঁজুরের রস নিয়া আইলাম। উত্তরপাড়ার সবুর মিয়ার গাছ কাটাইছে কালকে। ঐ গাছের রস খালাম্মা। বেজায় মিঠা। বলে দুই হাতে ধরা দুইটা রসের ঠিলা দেখায় মনু গাছি। এলাকায় সে মনু গাছি হিসাবেই পরিচিত।
-একটু কষ্ট করে রান্নাঘরে রাইখা দিয়া আয় মনু। আইসা টাকা নিয়া যা।
বারান্দার শেষ মাথায় রান্নাঘর। আগে মাটির চুলায় রান্না করত সালেহা। এখন তার স্বামী দয়া করে গ্যাস সিলিন্ডার আনিয়ে দিয়েছে। সংসারের খরচা পাতি শমসের যা দেয় তাই হাত পেতে নেয় সে। শাড়ির আঁচলে গুজে রাখা পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে মনু’র হাতে দেয়। মনু খুশি হয়ে বিদায় নেয়। এই ভয়ঙ্কর শীতের মধ্যেও ছেলেটার গায়ে একটা হাতাকাটা সোয়েটার খালি। সালেহার মায়া লাগে দেখে। কুয়াশার চাদরের মধ্যে মনু হারিয়ে যায়। সালেহা যায় রান্না ঘরে। স্বামীর জন্য নাস্তা বানাতে হবে। ঘরের কাজ সে একাই করে। খবর দিলে মাঝে মাঝে পাশের পাড়া থেকে পারুলের মা এসে টুকটাক কাজ করে দিয়ে যায়।

স্বামীর জন্য এক মগ রস রেখে দিয়ে বাকিটুকু জ্বাল দিতে বসে সালেহা। আতপ চাল দিয়ে পায়েস করবে। রস জ্বাল দিতে দিতে নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে টুকরো টুকরো করে। মা যখন রস জ্বাল দিত তখন সালেহা আর তার ভাই নজরুল মায়ের পাশে ঘোরাঘুরি করত। কে আগে পায়েস খাবে এই নিয়ে দুই ভাই বোনের মধ্যে সে কি ঝগড়া! কত রকমের পিঠা বানাতো মা শীতকালে। রস চিতৈ, পাটিসাপ্টা, ভাঁপা পিঠা, ভাজা কুলি, সেমাই পিঠা, পাকান পিঠা, পান পিঠা আরও কত রকম। সালেহার সব নামও মনে নাই। নজরুল আতপ চালের পায়েস খেতে খুব পছন্দ করত। ছোটবেলাতেই জ্বরের ঘোরে একদিন ভাইটাও মারা গেল সালেহার। মা বাবাও কেউ বেঁচে নেই এখন। ভাই এর কথা ভাবতে ভাবতে গিয়ে দুই চোখ দিয়ে পানি গড়ায়ে পড়ে। রসের উথলে ওঠা দেখে সম্বিত ফিরে পায়। তড়িঘড়ি করে জ্বাল কমিয়ে দেয়।

বারান্দা থেকে হাক দেয় শমসের। ‘সালেহা! সালেহা!’
রান্নাঘরে থেকে এক থালা পায়েস হাতে নিয়ে বারান্দায় উঠে আসে সালেহা। স্বামীর হাতে দিতে যাবে ঠিক তখনই আবির্ভুত হয় পুলিস কন্সটেবল নুরুদ্দিন। মাঝবয়সী এই লোকটাকে সাক্ষাত শয়তান বলে মনে হয় সালেহার। স্বামীর যাবতীয় কুকর্মের মদদদাতা হোতা এই নুরুদ্দিন। সালেহা সবই জানে কিন্তু মুখ বুজে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই তার। নুরুদ্দিন কে দেখে পায়েসের কথা মনে থাকে না শমসের মোল্লার।
-কি ব্যাপার নুরু? এই সকালে?
-জ্বী স্যার। আপনার লাইগা দরকারি খবর আছে।
-কি খবর? জলদি কও। মুখে লোলুপ দৃষ্টি ফুটে ওঠে শমসের মোল্লার।
-কথাডা স্যার... বলে নুরুদ্দিন ইতঃস্তত করতে থাকে।
শমসের বুঝতে পারে সালেহার সামনে নুরু বলতে চায় না। তাই সে নিজেই নুরু কে নিয়ে উঠানের মাথায় জাম্বুরা গাছের নিছে দাঁড়ায়। গোপন খবরের আনন্দে শমসের শীতের প্রকোপও টের পায় না। দুইজন পাঁচ মিনিট পরে সলা পরামর্শ করে ফেরত আসে। এসেই শমসের মোল্লা ব্যস্ত হয়ে নিজের সাফারী গায়ে দেয়। আলমারী খুলে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে থাকে। অবৈধ টাকার কমতি নেই তার।
-পায়েস খাইলা না? খেঁজুরের রস দিয়া করছি। মিনমিন করে বলে সালেহা।
-তোমার পায়েস তুমিই খাও বলে খেঁকিয়ে ওঠে শমসের।
সালেহা আর কথা বাড়ায় না। ঝাড়ু হাতে রান্না ঘরের দিয়ে রওনা দেয়।

***
জোনাকীপুর পতিতালয়ে আজ সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। মিনু কে দেখে মেয়েরা মুখ টিপে টিপে হাসাহাসি করছে। দালালদের আনাগোনাও বেশী। মিনুর মা নাছিমা আজ থেকে প্রায় ষোল বছর আগে মিনুকে জন্ম দেয় এখানে। মিনুকে পেটে নিয়ে হতভাগী এখানে এসে স্থায়ী হয়ে যায়। সভ্যসমাজ থেকে এই জগৎ পুরা আলাদা। এখানের কেউ মরে গেলে সাধারণ গোরস্তানেও এদের মাটি হয় না। এখানের কেউ স্কুলে লেখা পড়া করে না। কত ধরনের খদ্দের আসে এখানে। খদ্দেরের মন ভোলাতে পারলে তো পেট চলে মেয়েগুলার। যাদের বয়স বেশী হয়ে গেছে, খদ্দেরের লালসা মেটাতে পারে না, তারা নতুন নতুন মেয়ে চালানের চেষ্টা করে। ওদের কে সবাই খালা বলে। নাসিমাও এখন খালা। কোন পতিতার ঘরে মেয়ে শিশু জন্মালে তাকে বড় হবার পরে অবধারিত ভাবে মায়ের পেশাতেই আসতে হবে। আর ছেলে হলে হয় গলা টিপে মারো নয় বড় হলে পতিতার দালালী পেশায় লাগাও। মাঝে মাঝে অনেক বড় বড় অফিসারদের শুভাগমন(!) ঘটে। তখন পতিতালয়ে একটু উৎসবের আমেজ থাকে। মাঝে মাঝে কত বিদেশী সাহেব আসে। তখন কে তাকে ধরবে এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যার। এভাবেই চলে দিন।

আজ উৎসবের কারণ ভিন্ন। আজকে মিনু’র প্রথম রাত। আজকে মিনু পুরোপুরি এই পাড়ার হয়ে যাবে। ছোট বেলা থেকেই এসব দেখে আসছে মিনু। সে জানে তার নিয়তি এটাই। মেনে নিয়েছে সে। কারণ বাইরের জগৎ সংসার সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। তার ধারনা সে পতিতা হয়েই জন্মেছে। নাছিমা মেয়ের চুল বেঁধে দেয়। লাল রঙের একটা শাড়ি পড়ায়। চোখে মোটা করে কাজল দিয়ে মুখে একটু স্নো মাখিয়ে দেয়। পায়ে আলতা দিয়ে নকশা করে দেয় সোনালী। এই পতিতালয়ের কোন মেয়ের প্রথম রাতকে খুব ঘটা করে দেখা হয়। অনেক মোটা অঙ্কের টাকা হাঁকা হয় এর জন্য। মিনুর জন্য দরদাম করা হয়েছে দশ হাজার টাকা। একটা কুমারী মেয়ের সতীচ্ছদ বিদীর্ণ করার মূল্য দশ হাজার টাকা মাত্র! আজকে মিনুর কাছে আসছে এক বড় অফিসার। নাছিমা মেয়েকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিজের মনের ভেতর গুমরে মরা কষ্টগুলো আবার জীবিত হতে চায় নাসিমার। বাচ্চা নষ্ট করার মত করে নিজের মনের কথাগুলোকে নিজেই মেরে ফেলে সে।

দালাল রতন এসে খবর দেয়, খালা সাবে চইলা আইসে। জলদি কর।
-আমি খবর দিলে সাবেরে লইয়া আসিস। বলেই নাসিমা মেয়েকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে যায়। সোনালী আর জোছনা কাগজের ফুল দিয়ে সুন্দর করে বাসর ঘরের মত করে সাজিয়েছে। বেশ্যা’র বাসর ঘর! নাসিমা মেয়েকে বলে দেয়, মাথায় কাপড় দিয়ে খাটে বসে থাকতে। মেয়ে যন্ত্রচালিতের মত মায়ের কথা পালন করে। মা কে সে ছোট বেলা থেকেই অনেক ভয় পায়। ‘রতন উনারে লইয়া যায়’ বলে নাসিমা হাঁক ছাড়ে।

দুই মিনিট পরে রতন এসে নাসিমার হাতে একটা টাকার বান্ডিল এনে দেয়। নাসিমা খুশিমনে টাকা গুনতে থাকে। রতন পাশে দাঁড়িয়ে লোভাতুর চোখে টাকা গোনা দেখে। নাসিমা টাকা গুনে ওখান থেকে এক হাজার টাকা রতনের হাতে তুলে দেয়। রতন টাকা নিয়ে পকেটে ভরে। নাসিমা তার ঘরের আঁড়াল থেকে অপেক্ষা করে মেয়ের প্রথম খদ্দের কে হয় দেখার জন্য। রতন লোকটাকে এনে মিনু যে ঘরে আছে ওটা দেখিয়ে দেয়। রতনের আঁড়ালে ছিল বলে নাসিমা লোকটাকে ভাল করে দেখতে পারে নাই। মাত্র এক ঝলক দেখেই নাসিমা বুঝে নেয়। তড়িৎ গতিতে নাসিমা খাটের নিচে হাত চালিয়ে জিনিসটা পেয়ে যায়। দুই লাফে গিয়ে দাঁড়ায় মিনুর ঘরের সামনে। লোকটা দরজা বন্ধ করতে যাবে ঠিক এমন সময় নাসিমা প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। আচমকা এমন ধাক্কায় খদ্দের তাল সামলাতে না পেতে চিৎ হয়ে পড়ে যায় মেঝেতে। নাছিমা ঘরে ঢুকেই দ্রুত হাতে দরজা বন্ধ করে দেয়। মিনু মায়ের এই রুপ দেখে ঘরের দেয়ালের সাথে সেঁটে দাঁড়ায়। ভয়ে মেয়েটার চোখ কপালে উঠে গেছে।

-মাগী আসার আর টাইম পাইলি না? বলে জোরে খেঁকিয়ে ওঠে শমসের মোল্লা।
-খানকির পোলা শমসের! আমারে চিনস নাই? ভাল কইরা তাকাইয়া দেখ আমি কে। এখনও চিনস নাই কুত্তার বাচ্চা নটী’র পো? আমি নাসিমা। মনে পড়ে ষোল বছর আগের কথা? তোর বাড়িতে কাম করতাম?

ততক্ষণে বাম হাত ডলতে ডলতে উঠে দাঁড়িয়েছে শমসের মোল্লা। আচমকা পড়ে যাওয়ায় বাম হাতে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছে। নাছিমার কথা শুনে এই শীতের মধ্যেও ঘামতে লাগলো শমসের। মুখ হা হয়ে গেছে নাছিমার দিয়ে তাকিয়ে।

-ষোল বছর আগে আমারে খানকি বানাইলি। পেটে বাচ্চা দিয়া আমারে বেইচা দিলি দালালগো কাছে। বলেই বাম হাত দিয়ে প্রচন্ড এক ধাক্কা মারে শমসেরের বুকে। মিনু যেন বোবা হয়ে গেছে। ভয়ে আরো সেঁটিয়ে যায় দেয়ালের দিকে। তাল সামলাতে না পেতে শমসের খাটের উপরে গিয়ে বসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের ডান হাতে নিয়ে আসা রামদা দিয়ে দুই হাত দিয়ে শমসেরের ঘাড়ের বাম দিকে সর্বশক্তি দিয়ে কোপ মারে নাসিমা। শমসের কোন শব্দ করার আগেই ধারালো রামদা ওর গলা ভেদ করে বুকের উপরে নেমে আসে। গলা দিয়ে ঘড়ঘড় একটু শব্দ করেই খাটের উপরে পড়ে যায় শমসের মোল্লার প্রানহীন দেহ। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটে খাট আর দেয়াল মাখামাখি হয়ে যায়। মিনু এক চিৎকার দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার আগে শুধু এইটুকু শুনতে পায়, ‘এই হারামজাদাই তোর বাপ মিনু’।

***
নাছিমার কথার উপরে ভিত্তি করে ডি এন এ পরীক্ষা করে প্রমাণিত হয় শমসের মোল্লাই ছিল মিনু’র জন্মদাতা। বিচারে নাছিমার যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়ে যায়। সব ঘটনা শোনার পরে, স্বামীকে হত্যা কোন অভিযোগই সালেহা করে না। আদালত থেকে নাছিমাকে নিয়ে যাওয়ার সময় সালেহা বিড়বিড় করে কি যেন বলে। নাসিমা সেটা বুঝতে পারে না।

Author's Notes/Comments: 

2nd December 2011

View shawon1982's Full Portfolio