একজোড়া সোনার চুড়ি

নিজের স্মৃতিকথা কখনও লিখতে ইচ্ছা করে আবার কখনও মনে হয় কি হবে লিখে? নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারি না মাঝে মাঝে কিছুতেই। পুরানো দিনের অনেক কথা এক এক করে মনে ভিড় করতে থাকে। তার কতগুলো সুখের যেমন, ঠিক তেমনি কতগুলো নিতান্তই দুঃখের। একাকীত্বের এই প্রবাস জীবনে মাঝে মাঝে অবসর কাটে সেইসব সুখ দুঃখের স্মৃতিচারণ করে। চার বছর হয়ে গেল আমি দেশের বাইরে অবস্থান করছি। মনের থেকে আমি কখনই মেনে নিতে পারি নাই আমার এই প্রবাস জীবনকে। চার বছরের একটি দিনও আমার নিজের কাছে আপন বলে মনে হয় নাই। সারাক্ষণ মনে হয়েছে, এইত আমি হয়ত কোথাও বেড়াতে এলাম, ঠিকই একটু পরে আবার ঘরে ফিরে যাব। ঘরে ফেরার আকুতি আমার মনকে কুরে কুরে খায় প্রতিনিয়ত। কাউকে বোঝাতে পারি না আমার মানসিক অবস্থাটা। অবশ্য আমার এই অবস্থার জন্য আমি কাউকে দোষ দেই না। আমি নিজেই দায়ী। লেখাপড়া করার জন্য আমি স্বেচ্ছায় প্রবাস জীবনের শৃংখল নিজের গায়ে জড়িয়ে নেই। যখন প্রতিনিয়ত নিজের অসহায়ত্বের কাছে নিজে ধরা পড়ি, তখন নিজের ক’ফোঁটা অশ্রুকে সঙ্গী করে নিজের মত করে বলে উঠি, এসবের কতটা দরকার ছিল?

আমি আমার আম্মুকে সবসময় অনেক বেশী মিস করি। বিশেষ করে এই প্রবাস জীবনে। ছোটবেলার টুকরো টুকরো কিছু কথা বিচ্ছিন্ন ভাবে মনে পড়ে। ফেলে আসা সব মুক্তাগুলো দিয়ে নতুন করে আবার সেই মালা বানানো যাবে না; কিন্তু হয়ত কিছু মুক্তা কুড়িয়ে পাওয়া যাবে। আমার শিক্ষাজীবনের শুরুতে যখন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়তাম তখন আম্মুর হাত ধরে ধরে স্কুলে যেতাম। আম্মু একটু একটু পর পর দরজার সামনে গিয়ে আমাকে দেখে না গেলে কান্নাকাটি শুরু করে দিতাম। আম্মু নানা ধরনের টিফিন কিনে নিয়ে আসত আমি যেগুলো পছন্দ করতাম। সেই সব টিফিন গুলার মধ্যে আজকে ক্রিমরোলের কথা খুব মনে পড়ছে। আঙ্গুল দিয়ে ক্রিম বের করে করে খেয়ে নিতাম। স্কুলে যাবার আগে আম্মু আমাকে স্কুলের ড্রেস পরিয়ে দিয়ে শার্ট ইন করে দিত। এরপর মাথার ছুল আঁচড়ে দিত বাম দিকে এক্তা সিঁথি কেটে। ঘরে ফেরার পরে আম্মুর হাত ধরে ধরে হোমওয়ার্ক শেষ করতাম। তখন আমি প্লে গ্রুপে পড়ি।

১৯৮৮ সালের জানুয়ারী মাসে আম্মু আমাকে নিয়ে সৌদিতে চলে গেলেন। আব্বু তখন ওখানে ব্যবসা করতেন। জেদ্দাতে আব্বুর সাথে দেখা হল। আব্বু নিজে প্রবাসী ছিলেন বলে আমার পক্ষে উনার কোন স্মৃতি ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। তখন আমার বয়স মাত্র ৫ বছর ছিল। আব্বুকে আমি সম্মধোন করতাম, ‘এই, এইযে, শোন’ এইভাবে। আব্বু আম্মুকে কিছু বলতে বললে আমি গিয়ে আম্মুকে বলতাম, আম্মু ঐ লোকটা তোমাকে ডাকছে। আম্মু চেনালেন যে উনি আমার আব্বু হন। উনাকে ‘আব্বু’ বলে ডাকার কথাও শেখাতে লাগলেন। ওমরা হজ্জ্ব করার সময় এত মানুষ দেখে আমি ভয় পেতাম যদি আমার আর আমার আম্মুর স্যান্ডেল চুরি হয়ে যায়। আব্বু আম্মু যেখানেই নামাজ পড়ত আমি আমার আর আম্মুর স্যান্ডেল বুকে জামার সাথে চেপে ধরে আম্মুর নামাজের ঠিক মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়ে থাকতাম। বলা বাহুল্য আব্বুর স্যান্ডেল নিতাম না, কারণ তখন আমি তাকে ‘আব্বু’ হিসাবে চিনতাম না। পরে অবশ্য আব্বুর সাথে অনেক সখ্যতা গড়ে ওঠে আমার। বড় হবার পরেও আব্বুর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আজও আছে।

সৌদি আরবে আমরা ‘আর আর’ নামক অঞ্চলে থাকতাম। আমাদের বাসার সামনেই ছিল আব্বুর ওয়ার্কশপ। আমি বারান্দা দিয়ে আব্বুর কাজ করা দেখতাম আর চিৎকার করে মাঝে মাঝে ডাকাডাকি করতাম। আমাদের একটা গাড়ি ছিল সাদা রঙ এর। আমরা ওটাতে করে ঘুরতে যেতাম। আমি সবসময় বসতাম আম্মুর ঠিক পিছনের সীটে। ওটা আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। বাসায় আম্মু নানা রকমের মজার খাবার তৈরি করত। মুরগী পোড়া, সমুচা, মুড়ি এইগুলা বাসাতেই বানাতো। আমার বড় খালার বাসা আমাদের বাসার খুব কাছেই ছিল। উনারাও সৌদিতেই থাকতেন তখন। আমি উনাদের বাসায় যেতাম আর থাকতাম ও। একদিনের কথা মনে পড়ে। আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম দেখে আমাকে আর ডাকে নাই। আমি হাতড়ায়ে দেখি আমার পাশে আম্মু নেই। মনটা হাহাকার করে উঠল। অনেক রাত হয়ে গেছিল। ঘুমাতে আর পারলাম না। চোখে ফেটে কান্না আসতে লাগল। দেয়াল হাতড়াই আর বারবার আব্বু আম্মুর মুখ ভেষে ওঠে। কাউকে কিছু বলতেও পারছিলাম না আমার দুঃখের কথা।

দুই বছর পরে দেশে চলে আসি। আমরা তখন থাকতাম শ্যামলী আদাবরে। আম্মু আমাকে ক্লাস টু তে ভর্তি করিয়ে দিল। স্কুল ছিল মিরপুর ১১ নাম্বার এ। এখন যেখানে মিল্ক ভিটা ফ্যাক্টরি আছে সেখানে। বাসা থেকে রিক্সায় করে শ্যামলী সিনেমা হল বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত এসে পাবলিক বাসে করে মিরপুর যেতাম। এরপর আবার রিক্সায় করে স্কুলে। বেশ দূরের পথ ছিল। প্রথম দিন স্কুলে যাবার পথে আম্মুকে নিজেই বললাম, এখন তো আমি বড় হয়ে গেছি, এখন আমি আর তোমাকে দেখতে না পেলে কাঁদব না। আম্মু আমাকে বোঝালো অনেক। স্কুলে গেলাম। ভুলে গেলাম আমার প্রতিজ্ঞার কথা। একটু পরে আম্মুকে দেখতে না পেয়ে অঝোরে কাঁদা শুরু করলাম। আম্মুকে চোখের সামনে দেখব না এটা আমি ভাবতেই পারছিলাম না। ক্লাসের সবাই অবাক হয়ে আমাকে দেখতে লাগল। আমাদের টিচার ছিলেন খাদিজা ম্যাডাম। আমার মন খারাপ বুঝতে পেরে উনি বাইরে গিয়ে আম্মুকে ডেকে আনলেন। আম্মুকে দেখে আমি শান্ত হলাম। আম্মু আমাকে নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করত। পরে ১৯৯০ সালের আগষ্ট মাসে আব্বু দেশে এসে একটা মোটর সাইকেল কিনে ফেলে। আমি ওতে করে আব্বুর সাথে যাতায়াত করতাম। আমি ছোট ছিলাম দেখে বসতাম তেলের ট্যাঙ্কির উপরে আব্বুর সামনে। এখন আর বসতে পারি না। বুঝতে পারি, আমি আর ছোট নেই। আমি আসলে বড় হয়ে গেছি। কিন্তু আমি চাইনি কখনও বড় হতে।

ক্লাস থ্রিতে যখন পড়ি তখন আমার অসুখ দেখা দিল। আমার সারা গা ঘা পাঁচড়ায় ভরে গেল। এত ভয়াবহ আকার ধারন করল যে তখনকার কথা মনে করলে আমার গা এখনও কাঁটা দিয়ে ওঠে। শরীরে কোথাও বাদ ছিল না। সারাক্ষণ গায়ে জ্বর থাকত। পায়ের তলাতেও উঠেছিল ঘা। একসময় এমন হল যে হাঁটতেও পারছিলাম না ঠিকমত। আমার দুই হাতের আঙ্গুল গুলা এমনভাবে আক্রান্ত হল যে আঙ্গুল ভাঁজ করার উপায় ছিল না। ডাক্তার পানি লাগাতে মানা করে দিল। আমার অবস্থা নিতান্তই শোচনীয় হয়ে গেল। একসময় এমন অবস্থা হল যে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার পরে শৌচকার্য নিজে করার আর উপায় রইল না। একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে সাহা্য্যের জন্য আম্মুকে ডাক দিলাম। খুব মানসিক কষ্টে ছিলাম আম্মুকে এই পরিস্থিতিতে ডাকতে হল দেখে। একটু ভয়ও পেলাম। আম্মু কি মনে করবে তাই ভেবে। আম্মু হাসিমুখে আমাকে পরিস্কার করে দিলেন। মুখে কোন রকম ঘৃণা বা অবজ্ঞার ছাপ দেখলাম না। উলটা আমাকে আদর করে দিয়ে বলল, ‘কতদিন পরে আমার বাবাটাকে আমি সুচু করায়ে দিলাম’। এই ঘটনা আজও যখনই আমার মনে পড়ে আমি কোন ভাবেই নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। কথাগুলা লিখতে গিয়েও চোখ টিস্যু পেপারে মুছে নিয়ে লিখছি। অনেক বড় হয়ে গেছি এখন কিন্তু এই কথা বলতে আমার কোন লজ্জা নেই। অসুস্থ অবস্থায় ভাত খেতে পারতাম না বলে আম্মু ভাত মাখিয়ে দিত, চামুচ দিয়ে খেতাম আর কখনও মুখে তুলেও খাওয়ায়ে দিত। আরও পরে যখন আমি ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি, একবার আমার অনেক জ্বর আসল। অনেকটা জ্বর ছিল আমার। অচেতনের মত পড়ে থাকলাম বিছানায়। আম্মু সারাটা রাত আমার পাশে জেগে কাটালো। আমি জখন জ্বরের ঘোরে জেগে উঠেছি তখনই দেখেছি উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে জ্বর দেখছেন আর আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেমন লাগছে।

পরীক্ষা ভীতি থেকে আমি কখনই মুক্তি পাই নি। এত বড় হয়ে গেলাম কিন্তু এখনও পরীক্ষার কথা শুনলেই আত্মা কেঁপে ওঠে। ভয় লাগে অনেক। স্কুল জীবনে এই ব্যাপারটা অনেক বেশী ছিল। ভয়ে আমার নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দেবার উপক্রম হত। আম্মু আমার টেনশন দেখে আমাকে সান্ত্বনা দিতেন। বলতেন, ‘ভয় পাও কেন? যা হবার হবে। কোন দুশ্চিন্তা কর না। হয় জয় নয় ক্ষয়’। উনার কথাগুলা এখনও আমার মনে বাজে। কখনও দুশ্চিন্তা হলে মনে হয়, হয় জয় নয় ক্ষয়। তখন আর খারাপ লাগে না। নিজের মনের থেকেই সান্ত্বনা পেয়ে যাই যেমনটা আগে পেতাম। পড়তে বসলে যখন কিছু পারতাম না বা খারাপ লাগত তখন পড়ার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে আম্মুকে দেখে আসতাম। মনে হত আমার ভিতর থেকে সব বোঝা নেমে গেছে। ভার্সিটিতে পড়ার সময়ও এই ঘটনার ব্যতিক্রম হয় নি কখনও। শুধু এখন এই প্রবাস জীবনে এসে আমি বড় একা হয়ে গেছি। এখন খারাপ লাগলে নিজের মধ্যে নিজেকে গুটায়ে ফেলি শামুকের মত। আম্মুকে তো কাছে পাই না যে উনাকে দেখে একটু সান্ত্বনা নিয়ে আসব। জানি না কেন মাঝে মাঝে আমার এই প্রবাস জীবনটা আমার কাছে অভিশপ্ত মনে হয়। শুধু মনে হয় এই কারণেই যে ইচ্ছা হলেই আব্বু আম্মুকে দেখে আসতে পারি না। বিছানায় শুয়ে নিজের মত করে অসহায় হয়ে কাঁদতে থাকি কিন্তু এখন তো কেউ সান্ত্বনা দেয় না!

প্রবাস জীবনে আসার পরে আম্মুকে অনেক পীড়াপিড়ি করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তোমার কিছু লাগবে কিনা। কখনই উনি বলেন নাই যে উনার কিছু লাগবে। কখনই উনার কোন কিছু চাহিদা থাকে না। আমি জোর করে করে এটা ওটা পাঠাই। এবার শুধু জানতে পেরেছিলাম উনার দুইটা সোনার চুড়ির শখ। খুব বেশী যে শখ তাও না। কারণ অলঙ্কার আম্মুকে পরতে দেখি না তেমন কখনই। আম্মুর দু’টা সোনার চুড়ি আগে ছিল। কিন্তু কোন কারণ বশতঃ সেটা বিক্রি করে দেয়া হয়। আমি বুঝলাম সোনার চুড়ির প্রতি উনার ভাললাগা কাজ করত। ঐদিন থেকেই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেই, যে করেই হোক আম্মুকে দুইটা সোনার চুড়ি কিনে দেব। নিজের ইনকামের টাকা জমায়ে প্রথমেই উনাকে এটা কিনে দেব। কিন্তু সেই দিন আমার এখনও এলো না। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন নিজের ইনকাম করা টাকা দিয়ে আম্মুর জন্য একজোড়া সোনার চুড়ি কিনতে পারবো। দিন যায়... আমার প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয় না।

Author's Notes/Comments: 

4th and 5th February 2012

View shawon1982's Full Portfolio