রক্তাক্ত অবগাহন

কপালে যে গ্রিলের দাগ পড়ে গিয়েছে সে খেয়াল নেই। সেই কখন থেকে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। মুখের উপর সরু একটা দাগ। স্পষ্টই বোঝা যায় যে অশ্রু শুকিয়ে গালের উপরে দাগ পড়ে গেছে। সারা আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। যে কোন সময় বৃষ্টি শুরু হতে পারে। আকাশে বজ্রের চমক দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। শরীর আর মন কোনটাই যেন আর সাড়া দিচ্ছে না। কত ধকল গেল কয়দিন। মনের মধ্যে যেই ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার সাথে কিছুতেই তাল মেলাতে পারছে না। এই সময়ে তার হাসিখুশি থাকা দরকার কিন্তু সেই মন মানসিকতা কোথায়? কাছেই কোথায় যেন হঠাৎ কড়াৎ করে বাজ পড়ল। এমন বাজের শব্দে মানুষ বিচলিত হয়ে যায় কিন্তু ওর কোন ভাবান্তর হল না। গালের উপরে শুকিয়ে যাওয়া দাগটাকে তাজা করতেই যেন আরও দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
মাথার উপরে হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো। বাবাকে দেখে তাড়াতাড়ি হাতের উলটা পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিল। বাবার শরীরটাও যে খুব একটা ভাল নেই। আর এই দুর্ঘটনার পরে মনটাও ভেঙ্গে গেছে। নীলার দুই গাল ধরে বললেন, এখন ভেতরে চল মা। আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবি? কিছু তো খেলি না সকাল থেকে? এমন করলে কি শরীর টিকবে?
আমার কিছু ভাল লাগছে না বাবা। আমি পরে খাব।
যা হয়ে গেছে তা তো আর ফেরানো যাবে না মা। নতুন করে সবকিছু চিন্তা করতে হবে।
চাইলেই কি সব পারা যায় বাবা? অনেক চেষ্টা করলাম। মনকে তো মানাতে পারছি না।
সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু সময় লাগবে আর কি।
সব ঠিক হলেই ভাল। বাবা আমি ভেবেছি কোন একটা কাজ করব। তুমি কি আমার জন্য কোন একটা কাজ জোগাড় করে দিতে পারবে?
সে না হয় করা গেল, কিন্তু তুই এই শরীরে কাজ করবি কিভাবে?
শুধু শুধু এভাবে ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগছে না বাবা। কিছু একটা করা দরকার। মন ভাল লাগে না। মনকে অন্যদিকে ঘোরাতে চাই।
ঠিক আছে তাই হবে। কিন্তু এখন কিছু একটু আগে খেয়ে নে।
তুমি যাও বাবা। আমি আসছি। একটু পরে খাব। এখন ভাল লাগছে না।
শরীর কি বেশী খারাপ লাগছে রে? ডাক্তারের কাছে যাবি নাকি?
না এখন যাব না। আমার কিছু ভাল লাগছে না বাবা। বলেই বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত কেঁদে ফেলল। বাবার বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে বলল, আমার সংসার টা ভেঙ্গে গেল বাবা। আমার সংসার টা ভেঙ্গে গেল......
মেয়েকে সান্ত্বনা দেবার কোন ভাষা না পেয়ে বোরহান সাহেব নিজেও নীরবে অশ্রু ফেলতে লাগলেন।

নীলার স্বপ্নগুলো যেন আষাঢ়ের বৃষ্টির মত এক এক করে ঝরে পড়ে গেল। সবকিছু কেমন যেন শুরুতেই শেষ হয়ে গেল। দৈবাৎ কোন কিছু ফেরানো যায় না যেমন ঠিক তেমনি মন থেকে মেনে নেয়াও তো সহজ হয় না। মাত্র ৭ মাসের বিয়ের মাথায় যদি স্বামী চিরদিনের মত সবাইকে ছেড়ে চলে যায় তাহলে কিভাবে মেনে নেবে মন? জীবনের তো সবে শুরু ছিল! কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই যে জীবন নাটকের যবনিকা পতন হল। অফিসের কাজে গিয়েছিল নবীনগরের দিকে। ওখান থেকে ফেরার পথে আমিন বাজারের দিকে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তন্ময়ের। ঘটনা শোনার পর নীলা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। লাশের যে অবস্থা ছিল তা নীলাকে দেখতে দেয়া হয় নি। দেখার মত অবস্থাও ছিল না। শোকের প্রাবল্যে ও কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিল। পাগলের মত বারবার জিজ্ঞাসা করছিল যে তন্ময় কোথায়? আসছে না কেন এখনও? কেউ ওর কথার জবাব দিতে পারে নি। ঘটনার প্রায় দুই মাস হয়ে গেল। এখনও নীলা মেনে নিতে পারে না যে তন্ময় আর আসবে না। এখনও মনে মনে অপেক্ষা করে হয়ত কোথাও ভুল হয়ে গেছে। তন্ময় ঠিকই চলে আসবে। নীলাকে সাইক্রিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বলেছেন যে, চিন্তার কারণ নেই। আস্তে আস্তে শোক কাঁটিয়ে উঠতে পারবে। একটু সময় লাগবে আর কি। বারবার মনে হয় ওর, কখন আসবে তন্ময়? ওকে যে সুখবরটা এখনও দেয়া হয় নি!

প্রায় বছর খানেক আগে তন্ময়ের সাথে পরিচয় হয় নীলার। অনেক নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে। এরপর ভালোলাগা; তারপর বিয়ে। ইন্টারনেট এর একটা ব্লগ সাইট থেকে পরিচয় হয় ওদের। তন্ময়ের লেখা একটা ব্লগে নীলা মন্তব্য করে। ব্লগটার নাম ছিল, ‘এসো কর স্নান নবধারা জলে’। ওখান থেকে পরিচয়ের সূত্রপাত। মাঝে মাঝে কবিতাও লিখত তন্ময়। একসময় নীলা ওর কবিতার ভক্ত হয়ে ওঠে। যে ব্লগ থেকে ওদের পরিচয় ওখানেও একটা কবিতা ছিল। এত ভাল লেগেছিল যে ওটা মুখস্ত করে ফেলে নীলা। এখনও মাঝে মাঝে গুনগুন করে আবৃতি করতে থাকে আপনমনে-

“বাইরে চেয়ে দেখি আমি, তুমি ছিলে ওধারে-
নীরবে নিভৃতে;
আমার বাতায়ন পাশে।
কখন এলে তুমি? আমাকে বলোনি কেন?
আমি যে ছিলাম তোমার স্বপ্নে বিভোর!
বুঝতে পারিনি কখন হয়ে গিয়েছে ভোর।
প্রথম বর্ষার জলের মত-
আমার হৃদয় তুমি করে দিয়েছ সিক্ত,
আমি যে তোমায় দেখতে পারিনি!
অন্ধ আমি; অন্ধকারাচ্ছন্ন আমার জগতে
আমি ছিলাম তোমারই অনুরক্ত।
বাড়িয়ে দাও তোমার ও দু’টি হাত-
এসে ধর আমায়!
তোমার মত আমিও করে নিতে চাই
বর্ষার জলে অবগাহন।
তোমার ছায়ার পানে চেয়ে
একাকী আপন মনে গেয়ে যাই-
নিশ্চুপ রইলে কেন অশ্রুসিক্ত করতলে?
আকাশ ছুঁয়ে এলেই যদি; তবে এসো!
এসো কর স্নান নবধারা জলে”।

বিয়ের প্রথম রাতেই তন্ময় কে অবাক করে দিয়ে এই কবিতাটা মুখস্ত শুনিয়ে দেয় নীলা। ভীষণ অবাক হয়ে যায়। কিছু বলতেও যেন ভুলে যায়। একবার অবশ্য জিজ্ঞাসা করেছিল যে কি বুঝিয়েছ এই কবিতা দিয়ে? তন্ময় শুধু হেসে বলেছিল, ‘বৃষ্টির প্রতি আমার ভালবাসা’। নীলার পালটা জবাব ছিল, ‘কে এই বৃষ্টি শুনি? আমার সতীন নাকি? কই আগে বলনিতো’? জবাবে শব্দ করে হাসে তন্ময়!

বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে কত স্মৃতি রয়ে গেছে দু’জনের। দু’টা জিনিস ওর খুব প্রিয় ছিল। তার মধ্যে একটা ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টি শুরু হলেই ছাদে চলে যেত। একদিন নীলা গিয়েছে ডাকতে ঘরে চলে আসার জন্য; উলটো ওকেই হাত ধরে টেনে আনে ঝুম বৃষ্টিতে। কাকতালীয় হলেও সত্য যে, ওদের যেদিন প্রথম দেখা হয়, ঐদিনও অনেক বৃষ্টি হয়। আর সেদিনই তন্ময়ের বর্ষাপ্রীতি বুঝতে পারে। নীলা আগেই ওর ছবি দেখেছিল কিন্তু নিজের ছবি দেয় নি কখনও। একদিন মোবাইল ফোনে বলেছে, ‘যেদিন আমরা দেখা করব, সেদিনই আমাকে দেখতে পাবে। এর আগে না’।
তাহলে আমি তোমাকে কিভাবে চিনব? তন্ময় প্রশ্ন করে।
আমি তোমাকে চিনে নেব।
কি হয় তোমার ছবি দেখলে?
উহু! পত্রমিতাকে আগে ভাগে দেখতে হয় না।
কি হয় দেখলে?
দেখলে আগ্রহ কমে যেতে পারে।
কিন্তু তুমি যে আমাকে দেখেছো?
কে বলেছে তোমাকে ছবি দিতে? দেখালে কেন? নীলা ওপাশ থেকে শব্দ করে হাসে।
আমাকে যদি না দেখতে?
তোমাকে দেখতে আমার বয়েই গেছে!
তুমি তাহলে আমাকে কেন পছন্দ করেছ?
ওমা সে কি তোমাকে দেখে নাকি? আমি তো তোমাকে পছন্দ করেছি তোমার কবিতাগুলোর জন্য।
কই আগে বলনি তো?
আগে যে তুমি জানতে চাও নি!
তোমার সাথে কথায় পারা মুশকিল। তন্ময় হার মানে।

এরপরের সময় গুলো যেন কিভাবে পার হয়ে গেছে। কিছু টের পায় নি নীলা। পারিবারিক ভাবেও ওদের বিয়েতে কোন বাঁধা আসে নি। নীলার পরিবার সাদরে তন্ময়কে বরণ করে নেয়। নীলার বাবা মায়ের কাছে জামাতা নয় বরং একটা ছেলের মতই ছিল ও। যখনই আসত চঞ্চলতা দিয়ে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখত। দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে বোরহান সাহেব অনেক বেশী ভেঙ্গে পড়েন। মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে গিয়ে নিজেই অনেকবার হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছেন। এরপর থেকে বাবা মায়ের কাছে ফেরত আসে নীলা। এসব কথা ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এর মধ্যে গত মাসে ওর জীবনে আসে আর এক বিস্ময়কর চমক। সংবাদ টা পেয়ে শুধু নিজের মত করে বারবার বলতে থাকে, ‘তুমি কোথায় তন্ময়? তুমি এসো দেখে যাও’।

আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এমন মুষলধারে যে দূরের জিনিসও ঝাপসা দেখে যায়। এমন বৃষ্টিই তন্ময়ের পছন্দ ছিল। সারা শহর যেন পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে। বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে তালুর উপর কিছু বৃষ্টির পানি নিয়ে দেখলো। এরপর সেই পানি নিজের গালে স্পর্শ করলো। মনে হল যেন তন্ময়ের স্পর্শ। আবার বৃষ্টির দিকে তাকালো। ঝুম ঝুম শব্দের মাঝেই মনে হল যেন তন্ময় ওকে ডাকছে, ‘এসো নীলা! দেখছো না কেমন বৃষ্টি হচ্ছে?’

পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে নীলা। আলমারির উপর থেকে ছাদের চাবিটা নেয়। আজ আর কারো কথা শুনবে না। আজ ও বৃষ্টিতে ভিজবেই। তন্ময় যে ওকে ডাকছে! ছাদের দরজা খুলে মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। সারা গায়ে বড় বড় পানির ফোঁটা ঝরে পড়ছে। দুই দিকে দুই হাত বাড়িয়ে রয়েছে। তন্ময় ঠিক এমনই করতো। ছাদের উপরে ইঞ্চি দেড় দুই পানি জমে গেছে। নালা দিয়ে বের হয়েও সারতে পারছে না এত বৃষ্টি! রাস্তায় কোন গাড়ি বা রিক্সাও দেখা যায় না। সবাই মনে হয় যে যার ঘরে চলে গেছে। দুই একজনকে এখনো দেখা যাচ্ছে ছাতা মাথায় দিয়ে চলতে। পশ্চিমদিকের মাঠে কয়েকটা ছেলে পানিতে ভিজে ভিজে ফুটবল খেলছে। ঐদিক দেখতে দেখে অবচেতন ভাবে সামনে হেঁটে যায় নীলা। খেয়াল করে নি, হঠাৎ করে আড়াআড়ি করে বসানো পানির পাইপের সাথে পা বেঁধে জোরে হোচট খায়। শরীর প্রচন্ড কেঁপে ওঠে। সামলে নিতে চেষ্টা করে। কোনমতে পতনটা ঠেকাতে পারে আর কি! প্রচন্ড ঝাঁকি খেয়ে বসে যায় হাঁটুর উপর।

কোনমতে আঘাতটা সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। কিন্ত একি? মাথা প্রচন্ড চক্কর দিয়ে ওঠে। চোখের সামনে কেমন যেন ঘোলা দেখা যায়। তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার জন্য পা বাড়ায়। হঠাৎ করে তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে। সারা শরীর যেন অবশ হয়ে যায়। দুই হাত দিয়ে তলপেট জোরে আঁকড়ে ধরে নীলা। টলমল পায়ে এগিয়ে যেতে গিয়েও পারছে না। বুকের ভেতর প্রচন্ড জোরে ঢিপঢিপ করছে হৃৎপিন্ড। সেই সাথে মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। মনে হয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। মনের ভিতর কেমন যেন অশনি সংকেত ডেকে উঠল। শেষ রক্ষা বুঝি আর হল না! উরুসন্ধিস্থলের কাছে উষ্ণধারার অস্তিত্ব টের পায়। তাকিয়ে দেখে পাজামা লাল হয়ে পানিতে ভিজে নীচের দিকে নামছে। তন্ময়ের শেষচিহ্নটুকুর অস্তিত্ব বিলীন হওয়া বুঝতে আর বাকী থাকে না ওর। ছাদের উপরেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবার ঠিক আগ মুহুর্তে মনে হল শুনতে পায় তন্ময়ের কন্ঠ। তন্ময় গাইছে তার প্রিয় গান-
‘এসো নীপবনে, ছায়াবীথি তলে
এসো কর স্নান নবধারা জলে’।।

Author's Notes/Comments: 

10th July 2011

View shawon1982's Full Portfolio