বুয়েটের পি.এল স্মৃতিচারণ

#PL_Pendulum

 

সবাই তো দেখি বুয়েটের স্মৃতিচারণের অংশ হিসেবে পি.এল তথা ‘প্রিপারেটরি লিভ’ নিয়ে লিখছে। তা আমি বাদ যাবো কেন? হলে থাকতাম না বলে কি আমাদের কোন পি.এল এর স্মৃতি থাকতে নেই? শুরুতেই বলি এই জিনিস অর্থাৎ পি.এল কে চিনলাম কিভাবে? লেভেল-১, টার্ম-১ এ থাকতে আমার এক বন্ধু আমাকে বললো, “পাছায় লাত্থি তে কি করবি?” ওর প্রশ্ন শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। বললাম, মানে? ও বললো, আরে বুঝলিনা? পি.এল হলো পাছায় লাত্থি।

 

কারো কারো কাছে প্রিপারেটরি লিভ আর আমাদের কাছে পাছায় লাত্থি। সেই থেকে পি.এল শুনলেই আমার কাছে পাছায় লাত্থি ছাড়া আর কোন কিছুই মনে হয় নাই। প্রতি টার্ম এর শেষে ঘটা করে সপ্তাহ দুই তিনেক ধরে যে বাঁশ নেয়ার মহড়া চলে বুয়েটে সেটাকেই পি.এল বলে। এসব হলো শুরুর দিকের কথা। আমি হলে থাকতাম না। নজরুল হলের সাথে সংযুক্ত ছিলাম। বন্ধুদের কাছে হল জীবনের নানা রকম গল্প শুনতাম! ওরে কি আর “দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে?”

 

এই লেখাটা লিখতে গিয়ে হাসিতে আমার হাত কেঁপে যাচ্ছে বারবার। কিভাবে যে লিখবো আর কতখানি সেন্সর করবো ভেবে পাচ্ছি না। যদিও আমি সেন্সর করার খুব একটা পক্ষপাতী নই। তবুও আমাদের এই গ্রুপে অনেক সিনিওর বুজুর্গ মানুষ আছেন। উনাদের করুণ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে হলেও আমাকে কিছুটা সেন্সর করতে হবে। করুণ বললাম, কারণ আমাদের কান্ডকারখানা দেখে উনারা আমাদের যে কি ভাবেন সেটা একটা বিবেচ্য বিষয়। বর্তমানের ২০১৯ ব্যাচের অনেকের সাথে আমার পরিচয় আছে। সেই সুবাদের জানতে পারলাম ওদের কাছে জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগ হচ্ছে, #পিএল_বাড়া।

 

এক কথায় অনেক কিছুই বলা হয়ে যাচ্ছে। পি.এল কে বাড়ানোর সকরুণ আর্তিও জানানো হচ্ছে আর পি.এল যে ওদের কাছে আসলে কি সেটাও বলা হয়ে গেল। ছেলেপেলেগুলার বুদ্ধির তারিফ না করে পারি না।

 

আসল কথায় আসি। ২০০৬ সালের ঘটনা। আমরা তখন লেভেল-৪, টার্ম-১ এ পড়ি। টার্মের শেষে যথারীতি পি.এল বাড়ানোর হুজুগ উঠেছে। আমাদের দরকার থাক বা না থাক সেটা বিবেচ্য না। পি.এল_বাড়া অর্থাৎ পি.এল বাড়াতেই হবে, সেটা যেমনেই হোক। আর সেটার মোক্ষম উপায় হলো হল থেকে মিছিল বের করতেই হবে। তা একদিম আমি হল থেকে আমার এক বন্ধুর ফোন পেলাম।

 

আমাকে ফোনে ধরেই সে বললো, এত লেখাপড় করে কি করবি? পি.এল তো বাড়বে।

আমার চোখ খুশিতে কপালে উঠে গেল! আহ! পি.এল_বাড়া তাহলে সার্থক হতে চেলেছে এই সেমিস্টারেও!

সেই বন্ধুই আমাকে জানালো আজ রাতে হলে চলে আয়, আমরা সবাই মিছিল করবো।

আমি বেকুবের মত বললাম, দোস্ত আমি তো কখনও আন্দোলন করি নাই, তা কি করতে হবে আমাকে?

বন্ধু আমাকে অভয় দিয়ে বললো, আরে ধুর! তোকে কিছু করতে হবে না। তুই আসবি আর তামাশা দেখবি।

আমি সেদিন অতি উৎসাহে সন্ধ্যার মধ্যে হলে চলে এলাম। পি.এল বাড়ানোর একজন সক্রিয় যোদ্ধা আমাকে আজ হতেই হবে। মনে মনে আমি মহা উত্তেজিত।

 

রাত সাড়ে ১১ টার দিকে বন্ধুর সাথে নিচে নেমে এলাম। দেখলাম হলের নিচে ছেলেপেলে সব জড়ো হচ্ছে। সিনিয়র জুনিয়র সবাই। সবাই দারুন খোশগল্পে মেতে আছে। দারুণ একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ। অনেকটা ঈদের শপিং দলবেঁধে করতে যাবার মত অবস্থা। একসময় মিছিল যাত্রা শুরু করলো। আমার সেই বন্ধু কানে কানে বললো, এখন আমরা এক হল থেকে আরেক হলে যাবো। এরপর রাস্তায় নামবো। তুই খালি দেখতে থাক কি কি হয়!

 

শুরু হল নানামুখী মিছিল। প্রথমে কয়েক মিনিট পি.এল সংক্রান্ত দুই একটা আগুনঝরা(!) স্লোগান দেয়া হলো ফ্রন্ট রো থেকে। আর পেছন থেকে সবাই সমস্বরে চেচিয়ে উঠলো। এরপর শুধু হলো আসল কান্ড। মিছিলে শ্লোগানটা যে আসলে কি হচ্ছে সেটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হাসতে হাসতে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। হলে বারান্দা দিয়ে যাবার সময়, যেসব বন্ধুরা নামেনি মিছিল করতে, তাদের নাম ধরে ধরে তাদের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য মধুর বাণী বর্ষিত হতে থাকলো মিছিল থেকেই।

 

আমাদেরই ক্লাসের  এক বন্ধু ছোটন (ছদ্মনাম) বারান্দায় এসে দাড়িয়েছে মিছিল দেখতে। ও নামে নাই। ছোটন একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরা ছিল। আর যায় কোথায়, আমার পাশ থেকেই আরেক বন্ধু ছোটনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, এই ছোটন তোর ব্রা দেখা যায়! এই কথা শুনে আমি হাসতে গিয়ে আরেকটু হলে হেঁচকি তুলে ফেলতাম! স্লোগান দেয়া দূরে থাক, হাসতে হাসতে আমি বেসামাল হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার একটু হাসির রোগ আছে। হাসির কিছু পেলে অনেকটা হিস্টিরিক হয়ে যাই আমি।

 

এরপর শহীদ স্মৃতি হলের কাছ দিয়ে যাবার সময় শুরু হলো টিচারদের উদ্দেশ্যে আশীর্বাদ। সদ্য পাস করা লেকচারার স্যাররা কি আর করবেন। বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। কিছুদিন আগেও উনারা এসব মিছিলের নেতৃত্ব দিতেন। এখন শিক্ষক হয়ে যাওয়ায় এথিক্যাল কারণে উনারা তো আর রাস্তায় নেমে আসতে পারেন না। কোন যৌক্তিকতা নেই। হাতে ইশারা দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন, চালিয়ে যা তোরা! পেছন থেকে কেউ কেউ বলতে লাগলো, ‘স্যার! স্যার গো! ও স্যার! আর কত কঠিন প্রশ্ন করবেন। এইবার নামেন’।

 

এভাবে গালিগালাজের তুবড়ি ছুটিয়ে মিছিল মূল রাস্তায় নেমে আসলো। আমার দুই চোয়াল হাসতে হাসতে ব্যথা হয়ে গেছে। আমি আর নিতে পারছিলাম না এসব কথা। মিছিল যেই আসসানুল্লাহ হল পার হলো, অমনি কোন কারণ ছাড়াই ভি.সি স্যারের উদ্দেশ্যে শ্লোগান শুরু হয়ে গেল। “ভি.সির বি*তে, আগুন জ্বালো একসাথে”!

 

আমি কোন কারণ খুঁজে পেলাম না ভি.সি স্যার কি দোষ করলেন? আমি পেট চেপে রাস্তাতেই বসে পড়তে গেছিলাম। আমার দুই বন্ধু আমাকে বসতে দিলো না। টেনে উঠালো।

 

সর্বাপেক্ষা মারাত্মক শ্লোগানটা শুরু হল শের-এ-বাংলা হলের কাছে এসে। মিছিলের ফ্রন্ট রো আর ব্যাক রো দুই অংশো তালে তালে সুরে সুরে শ্লোগান শুরু করলো। ফ্রন্ট রো শুরু করলো “খে* দে” আর পেছন থেকে সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলো সবাই, “ধো*”! তালে তালে প্রলম্বিত লয়ে এই শ্লোগান চলতেই থাকলো কিছুক্ষণ। আমার পক্ষে সেন্সর না করে বলা সম্ভব হলো না। আমি আর পারলাম না। পেট চেপে রাস্তার উপরে ফুটপাথেই বসে পড়লাম। একটা মানুষ কতক্ষণ এমন একনাগাড়ে হাসতে পারে?     

Author's Notes/Comments: 

৩ মার্চ ২০২২

View shawon1982's Full Portfolio