গানে একটু ভুল

নামী দামী অনেক শিল্পীকেই দেখেছি অনেক সময় লাইভ পারফর্ম্যান্সে এসেও লিপ সিঙ্ক্রোনাইজ করে হাতে মাইক নিয়ে কিছুক্ষণ লাফালাফি করে যান। অর্থাৎ আগে থেকেই রেকর্ডেড গান গুলো বাজিয়ে সেগুলো স্টেজে উঠে হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে এমনভাবে ঠোঁট নাড়েন যেন মনে হয় এখনি গাইছেন। কিন্তু আগের রেকর্ড করা গানের সাথে স্টেজে সরাসরি গাওয়া হলে পার্থক্য অবশ্যই থাকতে হবে। কোন মানুষের পক্ষে তো দুই সময়ে গাওয়া গান হুবহু এক রকম করে গাওয়া সম্ভব নয়। কিছু না কিছু পার্থক্য তো থেকেই যায়। এটা মানুষ এখন বোঝে। কিন্তু ঐ আর কি! তালে তালে অনেক কিছুই বুঝেও না বোঝার ভান করেও আমরা বসে থাকি।

 

আমার কিন্তু শিল্পীদের লাইভ পার্ফরম্যান্স দেখতে বা লাইভ গান শুনতে অনেক বেশী ভাল লাগে। আমার প্রিয় শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের লাইভে গাওয়া গান আমি রেকর্ডেড গানের চাইতে মনে হয় অনেক বেশীবার শুনেছি। কারণ লাইভে তো প্রিয় শিল্পীকেই সরাসরি গাইতে দেখা যায়। আর লতা মঙ্গেশকর এমন একজন গুণী শিল্পী যে, উনার ক্ষেত্রে অনায়াসে বলা যায়, রেকর্ডেড গানের চাইতেও উনার লাইভের গাওয়া অনেক গানই শুনতে অনেক বেশি ভাল লাগে। কোন অটো টিউনিং করার যেহেতু সুযোগ থাকে না লাইভে, তথাপি উনি এমন ভাবে গানের প্রতিটি অংশ গেয়ে যান অবলীলায়, যে সেগুলো হঠাৎ করে শুনলে লাইভ না রেকর্ডেড, সেটা নিয়ে শ্রোতা ভ্রমেও পড়তে পারেন।

 

প্রিয় শিল্পীর লাইভে গাওয়া গান যেহেতু প্রায়ই শুনি, সেহেতু গানের কিছু কিছু পার্থক্য আমার কাছেও ধরা পড়ে। বয়সের সাথে সাথে শিল্পীর গলার স্বরেরও কিছু তারতম্য ঘটে বৈকি। চল্লিশের দশকে গাওয়া গান যখন মিলেনিয়াম কনসার্টে গাইলেন, তখন সেটা শুনলেই তো বোঝা যায় যে শিল্পী লাইভে গাইছেন। আর লতা মঙ্গেশকরের গান এতটাই নিখুঁত যে উনার স্বর শুনলেই বুঝতে পারা যায় এটা কি লাইভে গাওয়া না অনেক আগের রেকর্ড। যে কোন সাধারণ শ্রোতাও তারতম্য ধরে ফেলতে পারবে। এমন গুণী শিল্পীর ভুল ধরতে আমি আসিনি। তবে কয়েকটা ভুলের কথা মনে হয় বলাই যায়, যেগুলো শুনলে নিন্দুকেরা সহজেই বুঝতে পারবে, লতা মঙ্গেশকর লাইভে এসে লিপ-সিঙ্ক্রোনাইজ করে গান গেয়ে যান না বরং সেই গানটাই আবার নতুন করে দর্শকের সামনেই গেয়ে যান।

 

২০০২ সালে হায়দ্রাবাদে হওয়া কন্সার্টে লতা মঙ্গেশকর গাইলেন “কাভি খুশী কাভি গম” গানটি। এবং গানের এক জায়গায় একটু ভুল করে ফেললেন। গানের একটি কলি হল এমন “পেয়ার দিল সে কাভি ভি না হো কম”। কিন্তু স্টেজে উনি গাইলেন “পেয়ার দিল সে কাভি ভি না কম হো”। শেষের দুটি শব্দ এদিক ওদিক করে ফেললেন। যারা গানটি মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন, তারা শুনলেই দুটি শব্দের এদিক ওদিক হওয়া বুঝতে পারবেন। ওই একই কন্সার্টেই লতা মঙ্গেশকর উদিত নারায়নের সাথে কয়েকটি ডুয়েট গাইলেন এবং সেখানেও কিছু কিছু ভুল করে ফেললেন। কিন্তু সেই ভুলগুলো উনি আর উদিত নারায়ন মিলে এমনভাবে সামলে নিলেন যে সেটা তেমন খারাপ তো লাগেইনি বরং মনে হয়েছে, গানটি বুঝি একটু নতুন আঙ্গিকে গাওয়া হলো। “দিল তো পাগল হ্যায়” এবং “হামকো হামিসে চুরালো” এই গান দুটির মধ্যে লতা মঙ্গেশকরের কিছু কিছু ভুল চোখে পড়ে। উদিত নায়ারন কয়েক জায়গায় হাত দিয়ে ইশারাও করেন। তবে যাই হোক, ওটা তো আর পাশ ফেল এর কোন পরীক্ষা ছিল না। কাজেই এমন কিছু খারাপ লাগেনি। বরং নতুনত্ব ছিল।  

 

সিঙ্গাপুরে ল্যাবে যখন একা একা কাজ করতাম তখনও আমি লতা মঙ্গেশকরের লাইভে গাওয়া গানগুলো শুনতাম। একবার পুরনো কিছু কনসার্টের গান শুনছিলাম। সত্তুরের বা আশির দশকের হবে। আমার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। লন্ডন প্যালাডিয়াম কনসার্ট হতে পারে। ওখানে একটা ছোট খাট ‘মেডলে’ গাইলেন লতা মঙ্গেশকর। অনেকগুলো গানের মূল একটু কলি পরপর গেয়ে যাওয়াই হলো মেডলে। ওখানে শুনতে গিয়ে, কানে খট করে একটা গান বাজলো। লতা মঙ্গেশকর গাইলেন এভাবে-

 

“যা রে, যারে উড় যারে পাঞ্ছি

বাহারোকে দেশ যারে

ইয়াহা কেয়া হ্যায় মেরে পেয়ারে

কিউ উজাড় গায়ে দুনিয়া মেরে মান কি

যা রে...”

 

সলিল চৌধুরীর সুরে গাওয়া গানটি ‘মায়া’ ফিল্ম এর গান। এটির বাংলা ভার্সনও অনেক জনপ্রিয়। ‘যা রে যারে উড়ে যারে পাখি’ এটা হল বাংলাটা। কিন্তু আমার কথা সেটা না। আমার খটকা লাগলো ‘দুনিয়া’ শব্দটিতে। সন্দেহ হলো, দুনিয়া শব্দটাতো মূল গানে নেই। আমি আবার কম্পিউটারে এসে মূল হিন্দি গানটা দিলাম। আমার সন্দেহ ঠিক। লতা মঙ্গেশকর ‘দুনিয়া’ শব্দটি ভুল গেয়েছেন। মূল গানে আছে “কিউ উজাড় গায়ে বাগিয়া মেরে মান কি”। ভুলের মাধ্যমে আমি অনেক কিছু অনুধাবন করে ফেললাম। এজন্য ভুলটা আমার কাছে অনেক মধুর লেগেছিলো সেদিন।

 

 

বাগিয়া শব্দের অর্থ বাগান, আর দুনিয়া মানে তো পৃথিবী। এখানে পাখি টাকে যদি প্রেমের বা ভালবাসার রুপকার্থেই ধরে নেই (আসলেও সেটাই) তাহলে, বাগিয়া থেকে দুনিয়া শব্দটা মেডলে তে ভুল গাইলেও অর্থের দিক থেকে কিন্তু অনেক বেশি ব্যাপক ছিল। তাই নয় কি? ভালবাসার পাখিটা যখন উড়ে চলে যায়, তখন শুধু মনের সাজানো বাগানটা কেন, নিজের পুরো দুনিয়াটাই কি এলোমেলো আর অর্থহীন বলে মনে হয় না? আমার কাছে সেদিন সেটাই মনে হয়েছিল। আমার কাছে এখনও তেমনই মনে হয়। ভালবাসাহীন দুনিয়াটা পুরোটাই আমার কাছে একরকম অর্থজীন মনে হয়। সেটা আমি সেদিন এই গুণী শিল্পীর গানের মাধ্যমে উপলব্ধি করেছিলাম। সব ভুলই তো খারাপ নয়। শেখার মত মন থাকলে, ভুল থেকেও কত কিছু শেখা যায়।  

Author's Notes/Comments: 

১৩ জুলাই ২০১৩

View shawon1982's Full Portfolio