ভালবাসি রেডিও

রেডিওর সাথে আমার ভালবাসা কবে কখন হয়েছিলো তা ঠিক বলতে পারছি না। কারণ আমরা যখন সেই নব্বই এর দশকে স্কুলে পড়তাম তখনও আমাদের বাসায় বা কোন আত্মীয় পরিমন্ডলে রেডিও শোনার এত চল ছিল বলে মনে হয় না। তখন বাসায় বাসায় টিভি এসে গেছে। ডিস এন্টেনাও আসতে শুরু করলো নব্বই দশকের মাঝামাঝি। কিন্তু বাসায় যে ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল, তাতে তো রেডিও থাকতোই। মাঝে মাঝে রেডিও ছেড়ে টিউনিং করতাম। একেকটা চ্যানেল আসতো, এলোপাথাড়ি কিছু শুনে আবার বন্ধ করে দিতাম। শোনার উদ্দেশ্যে যে কিছু শুনতাম সেটাও না। এমনি নিছক নাড়াচাড়া করা। বড় টিউনিং নবটা দেখে নাড়াতে ভালই লাগতো।

 

বাবাকে দেখেছিলাম একবার ছাত্রদের ট্রেনিং করানোর জন্য কাঠের একটা পিড়ির উপরে লোহার পেরেক দিয়ে, সেগুলোর সাথে আই.সি এবং অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস কানেক্ট করে একটা রেডিও বানিয়ে ফেলেছিলেন। আমি যতবার উনার অফিসে যেতাম, ততবার মুগ্ধ হয়ে রেডিওটা দেখতাম। বাসায় ক্যাসেট প্লেয়ারে কখনও রেডিও শোনা হয়নি সেভাবে। তবে বড়দের কাছেই শুনেছি, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, রেডিওতে প্রচারিত খবরগুলোর মাধ্যমে দেশের মানুষ যুদ্ধের অবস্থা জানতে পারতো। এম. আর. আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ শুনে মানুষ অনুপ্রাণিত হতো। রেডিওর এই ভূমিকার কথা শুনে আমিও চমৎকৃত হতাম।  

 

বেশ কয়েক বছর যাবত আমার রেডিও প্রীতি বেশ বেড়েছে দেখা যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরেও মাঝে মাঝে কানে হেডফোন দিয়ে মোবাইলে শুনেছি। কিন্তু ওখানেতো সবই ওদের ন্যাটিভ ভাষায় আর না হয় ইংলিশে। শুনে তত মজা পেতাম না। দেশে আসার পরে যে খুব শুনেছি তা নয়। কারণ এখন রেডিও শুনতে হয় মোবাইলে। আলাদা করে কে আর ট্রাঞ্জিস্টর কিনবে? রেডিওকে কেউ কেউ ট্রাঞ্জিস্টর বলতো বলেই মনে পড়লো। এখনকার ছেলে মেয়েরা কতদূর রেডিও শোনে সে ব্যাপারে আমার কোন খতিয়ান জানা নেই। হয়তো শোনে কেউ কেউ। অনেকে আবার রেডিওর রেকর্ড করা প্রোগ্রাম গুলো ইউটিউবে শুনে নেয়। ইউটিউবে শুনলে তো নিজের ইচ্ছামতই শোনা যায়। কিন্তু রেডিও টিউন করে হঠাৎ করে যদি প্রিয় কোন গান কানে ভেসে আসে তাহলে তো নিজের অজান্তেই ভাল লাগার কথা।

 

অনেকে আবার নানা রকম অনুরোধ করে। অনুরোধ করা সেই ব্যাক্তির আকাঙ্খিত কোন জিনিস যদি তার নাম পড়ে শোনানো হয়, তাহলে মনের মধ্যে শিহরণ হওয়া কি খুব অস্বাভাবিক? অবশ্য রেডিওতে অনুরোধ জানালেও সবকিছুই তো মোটামুটি ইউটিউবে পাওয়া যায়। তবুও রেডিও তো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আমার মনে আছে, বাংলাদেশ সেই যে ১৯৯৭ সালে আই.সি.সি ট্রফি জিতলো, এক বলে এক রান! শ্বাসরুদ্ধকর সেই খেলা কিন্তু টিভিতে সম্প্রচার হয়নি। সারা বাংলাদেশের মানুষ রেডিওতে শুনেছিল বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয় আর সবাই একসাথে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল সেদিন!

 

এখনও আমার একাকীত্বের সঙ্গী হয় এই রেডিও। একা একাই শুনি। কানে হেডফোন দিয়ে। কিছুদিন আগে যখন নোকিয়া-১০৫ কিনলাম, তখন বোকার মত দোকানদার কে প্রশ্ন করে বসেছিলাম, আচ্ছা রেডিও আছে তো! উত্তরটাতো জানাই ছিল! সেই প্রথম যুগের মোবাইলেই যেখানে রেডিও ছিল, এখন না থাকার তো প্রশ্নই আসে না। দোকানদার বলেছিল, আছে স্যার! তবে আপনাকে হেডফোন দিয়ে শুনতে হবে! ব্যাপারটা আগেই জানতাম। আবার নতুন করে জানলাম শুধু রেডিও ভালবাসি বলে।

 

আমার একা থাকতে ভাল লাগে না। রীতিমত ভয় লাগে। কখনও যদি ঘরে একা ঘুমাতে হয় তাহলে আমি লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাই। লাইটে আমার ঘুমের অসুবিধা হয় না, কিন্তু একা একা ঘুমাতে কেমন যেন ভাল লাগে না। আমার প্রবাস জীবনের সিংহভাগ সময় আমাকে একা একা থাকতে হয়েছে। ঘুমাতে হয়েছে একাই। মনে পড়ে সেদিনগুলোর কথা। মনে পড়ে শেষ পাঁচ মাসের কথা। তখনকার একাকীত্বের যেন কোন তুলনা নেই। তখন কম্পিউটারে কিছু না কিছু ছেড়ে দিয়ে ঘুমাতাম। ধর্মীয় আলোচনা বা অন্যকিছু! মানুষের কথা শুনতে শুনতে ঘুমাতাম। মনে হত আমার পাশে যেন কেউ আছে। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, যখন অনন্ত শূন্যে আমাকে একা একাই থাকতে হবে, তখন তো আমি পাশে কাউকে পাবো না, তখন আমি কি করে থাকবো? তখন কি আমার সেই নিঃসীম শূন্যতা পূরণ হবে? আমি আশায় আশায় বসে থাকি।

 

আমার প্রবাসের সেই একাকীত্বের দিনগুলোতেও আমাকে এই রেডিও সঙ্গ দিয়েছে মাঝে মাঝে। আমি অকৃতজ্ঞ নই। আমার মনে পড়ে। রেডিওর প্রতি সেই ভাললাগা এখনও কাজ করে। এখন নিয়মিত বেতার নাটক হয় কিনা জানি না। তবে ইউটিউবে প্রকাশিত ‘আকাশবাণী কলকাতা’র বেতার নাটকের আমি রীতিমত ভক্ত। নিয়মিত আমি শুনি। শুনতে শুনতে নাটকের দৃশ্যায়ন কল্পনা করা আমার অনেক দিনের পুরানো অভ্যাস। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি টিভিতে দেখা নাটকের চাইতেও বেতার নাটক মনে হয় বেশিই ভালবাসি। রেডিওর প্রতি আমার এই ভালবাসা আসলেই পক্ষপাতদুষ্ট। ভাবতেই অবাক লাগে, প্রযুক্তির সাথে সাথে আদিম অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়ে গেলেও রেডিও কিন্তু এখনও বহাল তবিওতেই আছে। আমি বেতারে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানাদির কথা বলছি।

 

এখনও রাস্তা দিয়ে একা একা যখন হাঁটি বা কোথাও যাই, আমার মনে হয় রেডিও শুনি। আমার একাকীত্ব দূর করে দেয় নিমিষেই। বেশী ভাল লাগে খবর গুলো শুনতে। খুঁজে খুঁজে চেষ্টা করি খবর গুলো শুনতে। কিন্তু এখন যা দেখি, তাতে বেশীর ভাগ চ্যানেলেই শুধু গানের ছড়াছড়ি। ক্রমাগত ইংলিশ, হিন্দি গান বেজে চলেছে। বাংলাদেশ হিসেবে বাংলা গান তো থাকবেই। সবসময় তো আর গান শুনি না। আমার গঠনমূলক আলোচনা শুনতেও অনেক ভাল লাগে। আজকে একজন আর্কিটেক্ট এর জীবনের কথা শুনছিলাম। বেশ ভাল লাগলো।

 

আমাদের এই ব্যস্ত জীবনে ভাললাগার উপাদানগুলো আমাদের নিজেদেরই খুঁজে নিতে হয়। অনেক দায়িত্বের মাঝে নিজেকে হারিয়ে না ফেলে, নিজের জন্য, একান্তই নিজের জন্য কিছু সময় যদি বের না করা হয়, তাহলে আমাদের মনের সজীবতা কমতে থাকে। আমার রেডিও শোনা সেই কারণেই। প্রিয় শখের জন্য আলাদা করে যে সময় নষ্ট করি তা তো নয়। হাঁটাহাঁটি করার জন্য তো রাস্তায় বের হতেই হয়। বেশীরভাগ সময় আমার একাকীই বেরোরে হয়। আমি সঙ্গী আর পাবো কোথায় চাইলেই? তাই তখন আমার সাথে রেডিওটা সাথে নেই। মানে মোবাইলে রেডিও চালিয়ে হাঁটা শুরু করি। এতে করে দুটো লাভ হয় আমার। অনেক নতুন নতুন জিনিস কানে ভেসে আসে। সেগুলো শুনতে শুনতে নানা ধরনের আজেবাজে চিন্তা করা থেকে বেঁচে যাই। আর আমার হাঁটার ক্লান্তিটাও অনেক সহনীয় মনে হয়। মনে হয় আমার আশেপাশেই তো মানুষ আছে। তারা কথা বলে যাচ্ছে। তাহলে আমি আর একা হলাম কোথায়?

Author's Notes/Comments: 

২৮ জুন ২০২১

View shawon1982's Full Portfolio