লেখাপড়ায় ‘জাত-পাত’ শ্রেণী বিভাগ

আগের দিনে যেমন মানুষের ‘জাত-পাত’ নিয়ে তথা ‘রেসিজম’ নিয়ে অনেক কিছু হয়ে যেত, আমরা মনে হয় অনেকেই সেই আচরণ থেকে খুব একটা বেরিয়ে আসতে পারিনি। অনেক বিদ্যা অর্জন করেও আমাদের অনেকের মধ্যেই আর কিছু না হোক, বিদ্যা আর পঠিতব্য বিষয়ের অহঙ্কার রয়ে গেছে। অথচ, আমরা ভুলেই যাই, পৃথিবীতে মানুষ নানা শ্রেণীতেই বিভক্ত থাকবে, সবাই কখনও সমগোত্রীয় হয় না, হতে পারে না। সমাজের প্রতিটা মানুষই সবার উপরে কোন না কোনভাবে নির্ভরশীল থেকেই যাবে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সামাজিক জীব মানুষের মধ্যে এটা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তার মানে এই না যে কেউ তার পঠিতব্য বিষয়ের কারণে অন্য বিষয়ে পড়া কারও উপরে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ফেলেছে। আমের স্বাদ কে মাংসের স্বাদের সাথে তুলনা করা শুধু বোকামিই নয় বরং রীতিমত হাস্যকর। আমি কারও প্রতি বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ বা বিরূপ মানসিকতা পোষণ না করে, কেবলমাত্র আমার সারা জীবনে যা যা লক্ষ্য করেছি তার একটু উল্লেখ করবো।

 

ব্যক্তি জীবনে আমি আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা BUET থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়েছি কেমিকৌশল বা কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং থেকে। এঞ্জিনিয়ারিং এর সব ডিপার্টমেন্ট এর নামের কিছু সংক্ষিপ্ত রূপ বা এব্রিভিয়েশন আছে তা আমরা সবাই কমবেশী জানি। যেমন আমার ডিপার্টমেন্ট কে লেখা হয় সংক্ষেপে ChE দিয়ে। আন্তর্জাতিক ভাবে এভাবেই লেখে। কিন্তু মুখে বলার সময় আমি কখনই “সি এইচ ই” এভাবে উচ্চারণ করে বলি না। বলি ‘কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং’। এবং আজ পর্যন্ত সিনিয়র জুনিয়র কারও মুখে আমি কখনই “সি এইচ ই” এভাবে আমার ডিপার্টমেন্ট এর নাম উচ্চারণ করতে শুনিনি।

 

আমাদের সময় থেকে বলবো না বরং অনেক আগে থেকেই কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড এঞ্জিনিয়ারিং তথা CSE এবং ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ারিং তথা EEE এর বেশ সুনাম ছিল, চাহিদা ছিল, এখনও আছে। আমি আমাদের সময়ের কথাই যদি বলি, তাহলে দেখা যেত বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় যাদের মেধা তালিকায় শুরুর দিকে থাকতো, তারাই ঐ দুই ডিপার্টমেন্ট চয়েস দিয়ে নিয়ে নিতো এবং পেয়েও যেত। আমার মনে হয় এখনও এই ট্রেন্ড চলে আসছে। আমি যখন বুয়েটে চান্স পেলাম, ২০০১ সালে ৪০৮ তম হয়ে, তখন আমি অনেকের মুখেই হতাশার ছায়া দেখেছি! কারণ আমি তো আর CSE কিংবা EEE পাচ্ছি না। এগুলা তো বুয়েটের হট(!) আর টপ(!) সাব্জেক্ট! এখন উপায়? এগুলা যখন পাবো না তখন কি আর করা আমাকে নিতে হবে নিচের(!) বা নিচু(!) মানের কোন সাব্জেক্ট!

 

অনেক আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো আমাকে লিখতে হচ্ছে। আমি প্রচন্ড ভালবাসা নিয়ে আমার ডিপার্টমেন্ট ChE চয়েস দিয়েছিলাম এক নাম্বার এ! পেয়েও গিয়েছিলাম, কিন্তু আমার আশে পাশের মানুষ অনেকেরই কিছুটা হতাশার বাণী শুনতে হয়েছে। এমনকি আমার ‘বাবা’ ও আমার এই কেমিক্যাল এ পড়া মন থেকে শুরুতে খুশি মনে মেনে নিতে পারেন নি। কেন বললাম এই কথা? কারণ বুয়েটে ভর্তির এক মাস পরে উনি আমাকে জোর করে, এবং যথেষ্ট পরিমাণে খারাপ ব্যবহার করে আমাকে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষায় পাঠান (আমার প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও) এবং আমাকে এই কথা বলেছিলেন, ‘পারলে চান্স পেয়ে দেখাও। এরপর পড়া না পড়া তোমার ইচ্ছা’। আমাকে প্রচন্ড রকম ভাবে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঐ ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল আমার যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য সে আমি আদৌ ঐরকম কোন ‘জাতওয়ালা’ সাব্জেক্ট এ নিজেকে কোয়ালিফাই করতে পারি কি পারি না সেটা দেখার জন্য! কারণ বুয়েটের কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং পেয়ে আমি মনে হয় কোন ‘জাত’ এর সাব্জেক্ট এ পড়তে পারলাম না!

 

এবার অন্য প্রসঙ্গে বলি। সাব্জেক্ট এর এব্রিভিয়েশন নিয়ে কথা বলছিলাম। আমি এখন পর্যন্ত আমার বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র এবং আমার ছাত্র ছাত্রীদের কাউকে জিজ্ঞাসা করে “কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড এঞ্জিনিয়ারিং” বা কমপক্ষে “কম্পিউটার সায়েন্স” এই কথাটুকু বলতে শুনিনি। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমার সন্মানিত পাঠক কূলের কাছে, বন্ধুদের কাছে। আমি একদমই বলছি না যে উনারা কেউ অহঙ্কার করে এমন কথা বলেছে! আমি মোটেই এমন দাবী করছি না। শুধু আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এই ডিপার্টমেন্ট এর পড়ুয়া আমি কাউকে দেখিনি (আমার মনে পড়ে না) যে “সি এস ই” উচ্চারণ করা ব্যরিরেকে আমাকে অন্য কোন জবাব দিয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে আমার অনেক অনেক ছাত্র ছাত্রীই কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড এঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট থেকে পড়ে। তাদের কাছেও অনেক সময় আমার শুনতে নিতে হয় কেন কোন ডিপার্টমেন্ট এ পড়ে। সেখানেও একই কথা। যা হোক, এটা দোষের নয়। আমি কোন দোষ ধরছি না। ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ারিং এ যারা পড়ে, তারাও একই রকম। পুরা নাম উচ্চারণ করে না। “ই ই ই” বলতে একটু বিদঘুটে শোনায় দেখে তারা একটু রস করে বলে, “ট্রিপলি” তথা “ট্রিপল ই”। শুনতে মন্দ লাগে না। বেশ একটু রোমান্টিক রোমান্টিক লাগে শুনতে। আমার নেয়া একটা কোর্সের বেশীর ভাগ ছাত্র ছাত্রীই কিন্তু “ট্রিপল ই” ডিপার্টমেন্ট এর এবং তারা অনেক ভাল করছে। সবার জন্য আমার অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।

 

আমাদের এব্রিবিয়েশন বলার একটা কারণ আছে। কারণ ওরাও জানে আমরা এগুলার মানে জানি। কিন্তু সবাইকে যে “সি এস ই” বা “ট্রিপল ই” এর মানে জানতেই হবে এমন কোন কথা নেই। সেক্ষেত্রে ফুল ফর্ম বললেও কিন্তু শুনতে খারাপ লাগে না। আমার অভিজ্ঞতায় বলে এছাড়া অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট এর বন্ধুরা কিন্তু শব্দ উচ্চারণ করেই আমাদের বলে। যেমন CE এর বন্ধুদের মুখে আমি কোনদিনও শুনিনি ওরা “সি ই” এভাবে বলেছে। ওরা সবসময় বলে “সিভিল”। ME এর বন্ধুরা বলে “মেকানিক্যাল”, MME এর বন্ধুরা বলে “মেটালার্জি”। সংক্ষেপে বললেও এভাবেই বলে, শুধু ওই দুই ডিপার্টমেন্ট ছাড়া। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন আর অসুবিধা হয় না। আমি বলছি না, ওরা জাত পাত বিবেচনা করে এমন কিছু বলে। এবার নিজের আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলবো।

 

তখন বুয়েটে লেভেল-২, টার্ম-১ এ পড়ি। ম্যাথ ক্লাস হচ্ছে। ম্যাট্রিক্সের ক্লাস চলছে। আমাদের ম্যাথ স্যারের নাম ছিল আব্দুল্লাহ আল মামুন স্যার। উনি আমাদের দুইটি কোর্স নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন করেছেন। আমি সবসময় ফার্স্ট বেঞ্চে বসতাম। একদিন ক্লাস নিতে নিতে কথা প্রসঙ্গে বলে বসলেন, ‘আমি তো একই কোর্স সি.এস.ই তেও নেই। ওরা তো অনেক মেধাবী’। এই কথা বলার সাথে সাথে, আমি কিছু না বলে সরাসরি স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম দুই সেকেন্ড! আমার ঠান্ডা চোখের ভাষা স্যার বুঝে ফেলেছিলেন। স্যার সাথে সাথে বলে উঠলেন, ‘না, তোমরাও অনেক মেধাবী, আমি আসলে ওভাবে মিন করিনি’। উনি মিন যেভাবেই করুণ না কেন, কথাটা কিন্তু বলা হয়ে গেল। দুই ডিপার্টমেন্ট এর মধ্যে জাপ-পাত, শ্রেনীবিভাগ থেকে অনেক শিক্ষকের মন মানসিকতাও মুক্ত ছিল না। একটা কৌতুকে পড়েছিলাম, ‘সরকারী দলের এক সাংসদ বলছেন, মাননীয় স্পিকার আমি আমি আমার বিরোধী দলের নেতাকে বাস্টার্ড (জারজ) বলতে পারি? সাথে সাথে স্পিকার বলে উঠলেন, না আপনি কখনই তা বলতে পারেন না। সাথে সাথে সাংসদ বললেন, আমি দুঃখিত মাননীয় স্পীকার’। ক্ষমা চাইলেন, কথাটা কিন্তু ঠিকই বলা হয়ে গেল।

 

নিজের আর সামান্য একটু কথা বলবো। আমি যে বিষয়ে পড়েছি, সেটাকে অনেক ভালবাসা নিয়ে পড়েছি। এবং আমি বিশ্বাস করি, নিজের বিষয়কে ভালবাসা নিয়ে অনুধাবন করলে মানুষ অনেক দূরে যেতে পারে। ভার্সিটিতে ক্লাস নেয়ার সময়, শুরুর দিকে আমার ছাত্ররা অনেকেই প্রশ্ন করে বসে, স্যার আপনি কোথা থেকে আন্ডারগ্রাড করেছেন’? আমার উত্তর সবসময় থাকে এটা “বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়”। একমাত্র ইউনিভার্সিটির টিচার ছাড়া আমি কারও সামনে “বুয়েট” শব্দটা উচ্চারণ করি না। আর সিঙ্গাপুরে যখন থাকতাম তখন তো ‘বুয়েট’ ও বলা যেত না, কারণ ওরা এব্রিভিয়েশন কে শব্দের মত করে উচ্চারণ করে না। তখন বলতে হত “বি ইউ ই টি”। একদিন ক্লাসে এক ছাত্রকে বললাম “বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়”। দেখলাম ওর চোখ কিছুটা বিকারহীন হয়ে গেল। ক্ষণিকের জন্য ও বুঝে উঠতে পারেনি। আমি বুজতে পেরেছিলাম। সাথে সাথে ওর পাশে বসা আরেকজন ওকে কনুই দিয়ে গুতা দিয়ে বলেছিল, “বুয়েট, বুঝোস না কেন”। ছেলেটির সম্বিত ফিরলো। আমি বোর্ডের দিকে ফিরে পড়ানোয় মন দিলাম। কি দরকার আমার “বুয়েট” উচ্চারণ করার, যদি ওটা বলার মধ্যে মনে কোন অহঙ্কার আসে?

 

শেষ করছি। জুতা, স্যান্ডেল তো সেলাই করাতেই হয় বা কালি করানো লাগে। আমি আমার এই জীবনে কখনও জুতা সারাতে গিয়ে পা সমেত জুতা এগিয়ে দেইনি কোন মুচি ভাই এর সামনে। রাস্তার উপরে জুতা খুলে খালি পায়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাতে তুলে জুতা তার সামনে এগিয়ে দিয়েছি। পাশে বসার মত কিছু থাকলে, পাশে বসে বসে ভাই এর কাজ দেখেছি। বয়স্ক হলে তাকে ‘কাকা’ বলে সম্বোধন করেছি। নানা রকম গল্প, পারিবারিক গল্প কথা জিজ্ঞাসা করেছি, খোজ খবর নিয়েছি আর তার কাজ দেখেছি। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই মানুষটার জন্য দোয়া করি। এই মানুষগুল আছে বলেই আমাদের সামাজিক জীবন এত সুন্দর লাগে।       

Author's Notes/Comments: 

২৭ এপ্রিল ২০২১ 

View shawon1982's Full Portfolio