শিয়াল কন্যা (কোরিয়ান লোকজ গল্প অনুবাদ)

ইংলিশ থেকে অনুবাদঃ ডঃ জায়েদ বিন জাকির (শাওন)

 

 

 

সে অনেকদিন আগের কথা। এক লোকের তিন ছেলে ছিল কিন্তু কোন মেয়ে ছিল না। তার অনেক দিনের বাসনা ছিল তার একটা কন্যা সন্তান হোক। সে পাহাড়ে গেল প্রার্থনা করতে ইশ্বরের কাছে। অনেক মাস প্রার্থনা করার পরে একসময় কিছুটা অধৈর্য হয়ে সে অনুনয় করে বলেই ফেললো, ‘হে প্রভু! আমাকে একটা কন্যা সন্তান দাও, যদি যে শিয়ালও হয়, তবুও একটা কন্যা সন্তান আমাকে দাও!’

 

কিছুদিন পরে তার স্ত্রী গর্ভধারণ করলো এবং একটি সুশ্রী কন্যা সন্তান প্রসব করলো। লোকটি ভীষণ খুশি হলো। কিন্তু মেয়েটির বয়স যখন ছয় বছর হল তখন লোকটি ব্যাখ্যাতীত একটি জিনিস খেয়াল করলো। প্রতি পূর্ণিমার রাতে একটি করে গরু মরে যেতে লাগলো তার, এবং কিভাবে বা কে গরুটাকে মেরে ফেলছে তা কেউ বলতে পারছে না। একদিন পূর্ণিমার রাতে লোকটি তার বড় ছেলেটিকে বললো পাহারা দিতে।

 

পরদিন সকালে লোকটির বড় ছেলে লোকটিকে এক রোমহর্ষক ঘটনার কথা বললো যা বিশ্বাস করাও কষ্টকর ছিল। ছেলেটি বললো, ‘বাবা! আমি যা দেখেছি তা আমার নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাদের ছোট বোনটা এই কাজ করেছে। আমি দেখলাম মাঝরাতে সে ঘর থেকে বের হয়ে এলো এবং দৌড়ে চলে গেলো আমাদের গোয়াল ঘরের দিকে। সেখানে গিয়ে সে মনের আনন্দে একা একা খানিক্ষণ নাচলো। এরপর খানিকটা তিলের তেল নিজের গায়ে এবং হাতে মেখে নিলো। এরপর প্রচন্ড শক্তি দিয়ে তার হাত গরুর পেটে সেধিয়ে দিয়ে দ্রুত গরুর কলিজাটা ছিঁড়ে বের করে আনলো। এত দ্রুত সে করেছে কাজটা যে গরুটা মারা যাবার আগে চিৎকারও করতে পারেনি। এরপর সেই কলিজা আমাদের বোনটা কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেললো। আমি এটাই দেখেছি বাবা, এরপর আমি সেখান থেকে পালিয়ে আসি। আমার পক্ষে আর সেই দৃশ্য সহ্য করা সম্ভব ছিল না’।  

 

এ কথা শুনে লোকটি চিৎকার দিয়ে বললো, ‘অসম্ভব! এ হতে পারে না। বাজে কথা না বলে সত্যি করে আমাকে বল কি হয়েছে?’

‘এটাই সত্যি কথা বাবা। আমি কিছুই বানিয়ে বলিনি!’ ছেলেটি মরিয়া হয়ে বললো তার বাবাকে।

লোকটি এবার ভয়ঙ্কর রেগে গেল। ছেলেকে বললো, ‘তার মানে তুই দুঃস্বপ্ন দেখেছিস! তুমি আমার কথার বরখেলাপ করেছিস! আমি তোকে বলেছিলাম পাহারা দিতে, সেটা না দিয়ে তুই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে এখন আমাকে গল্প বানিয়ে বলছিস! এখনই বেরিয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে। তোকে ছেলে বলতেও আমার কষ্ট হচ্ছে’। এই বলে সে ছেলেটিকে ঘর থেকে বের করে দিল।

এবার মেঝ ছেলের পালা আসলো পাহারা দেয়ার। এক মাস সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু যে রাতে পুর্ণিমা হলো, আবার সেই একই ঘটনা ঘটলো। মেঝ ছেলেও বাবাকে একই ঘটনা বললো যা তার বিতাড়িত বড় ভাই বলেছিল।  

আবার মেঝ ছেলের বর্ণনা শুনে লোকটি চিৎকার দিয়ে বললো, ‘অসম্ভব! এ হতে পারে না। বাজে কথা না বলে সত্যি করে আমাকে বল কি হয়েছে?’

‘এটাই সত্যি কথা বাবা। আমি কিছুই বানিয়ে বলিনি!’ মেঝ ছেলেটিও মরিয়া হয়ে বললো তার বাবাকে।

লোকটি এবারও ভয়ঙ্কর রেগে গেল। মেঝো ছেলেকে বললো, ‘তার মানে তুই দুঃস্বপ্ন দেখেছিস! তুমি আমার কথার বরখেলাপ করেছিস! আমি তোকে বলেছিলাম পাহারা দিতে, সেটা না দিয়ে তুই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে এখন আমাকে গল্প বানিয়ে বলছিস! এখনই বেরিয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে। তোকে ছেলে বলতেও আমার কষ্ট হচ্ছে’। এই বলে সে মেঝ ছেলেটিকেও ঘর থেকে বের করে দিল।

এবার এলো ছোট ছেলের পাহারা দেবার পালা। এবারো এক মাস সব ঠিক ছিল। এবারও ছোট ছেলেটি একই জিনিস দেখলো। কিন্তু বড় দুই ভাইয়ের সত্যি কথার পরিণতি তার জানা ছিল। এবার তাই ছোট ছেলেটি তার বাবাকে মিথ্যা কথা বললো। সে বললো, ‘বাবা! আমি রাতে দেখলাম আমার ছোট বোনটা বের হয়ে এলো। ও টয়লেটে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে আবার বের হয়ে আসলো। আমি ওর পেছন পেছন গিয়েছিলাম। আসার পথে যখন গোয়ালের কাছ দিয়ে এলাম তখন দেখলাম গরুটা মরে পড়ে আছে। আমার মনে হয় বাবা, আজ তো চাঁদের অনেক আলো, গরুটা মনে হয় এতো আলো দেখে ভয় পেয়ে মরে গেছে’। শুনে লোকটি বললো, ‘তুমি তোমার দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করেছো। তুমি ঘুমিয়ে যাও নি। তুমিই আমার যোগ্য উত্তরাধিকারী হবে। তোমাকে আমি আমার সব সম্পত্তির মালিক বানিয়ে দেবো’।   

 

 

এদিকে ঐ লোকের দুই ছেলে প্রায় ভিখিরি হয়ে গেল। সহায় সম্বলহীন হয়ে এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। উপায় না দেখে দুই ভাই এক সময় পাহাড়ের উপরে চলে গেল। সেখানে এক ঋষির সাথে পরিচয় হলো ওদের। ঋষি ওদের আশ্রয় দিলো। সব কথা শুনে ওদের কে তার কাছে কিছুদিন থেকে যেতে বললো। ওরা ঋষির কাছ থেকে নানা ধরণের উপদেশ বাণী শুনতে লাগল। এভাবে প্রায় এক বছর কেটে গেল। এরপরে ওরা চাইলো ওদের গ্রামে আবার ফিরে যেতে। ঋষি ওদেরকে যাবার সময় সাদা, নীল আর লাল রঙের তিনটা বোতল উপহার দিলো। আর বলে দিল, ‘তোমাদের যেমন শিখিয়েছি ঠিক সেভাবে এগুলো ব্যবহার করবে। তাহলে কোন শত্রু তোমাদের কিছু করতে পারবে না। এমনকি তোমার ওই মানুষরুপী শিয়াল বোনটাও তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।

দুই ভাই ঋষিকে ধন্যবাদ দিয়ে গ্রামে এসে শুধু বিরান ভূমি দেখতে পেলো। অনেক খুঁজে নিজেদের বাড়িটা দেখেও যেন চিনতে পারলো না। দরজা জানালা বলে কিছু নেই। ঘর বলে চেনাই যায় না। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু ওদের বোনটাকে দেখতে পেলো। আর খামার, গোয়াল ঘর এসবের নাম নিশানাও দেখতে পেলো না কোথাও। বোনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাকীরা সবাই কোথায়? ছোট ভাই? বাবা মা?’

বোনটা বললো, ‘ওরা যে যার কবরে শুয়ে আছে। আমি এখন একদম একা হয়ে গেছিতোমরা কি আমার সাথে থাকবে না এখন থেকে’? কে কিভাবে মারা গেছে মেয়েটি কিছুই বললো না। দুই ভাই ঠিকই বুঝে নিয়েছে সবাই কিভাবে মারা গেছে। শুনে দুই ভাই বললো, ‘না! আমরা আমাদের মত চলে যাবো। এখানে তো আমাদের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই’। তখন বোনটি বললো, ‘সন্ধ্যা তো হয়েই গেল। আজ রাতটা কি অন্তত থাকবে না তোমরা’?

 

একথা শুনে দুই ভাই নিমরাজি হয়ে গেল। কি অদ্ভুত ভাবে যেন বোনটি দুই ভাইয়ের জন্য নানা রকম খাবার আর সুপেয় পানীয় দিয়ে টেবিল ভরে ফেললো। এই দুই ভাইয়ের গত এক বছর এমন লোভনীয় খাবার ভাগ্যে জোটে নাই। খাবার পেয়ে দুই ভাই গন্ডেপিন্ডে খেয়ে নিয়ে ঘুমে তলিয়ে গেল। মাঝরাতে কেমন যেন একটা খচমচ শব্দে বড় ভাইয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলো পাশে তার অন্য ভাইটা নেই। এটা দেখেই মনে হলো, অন্য ভাই মনে হয় এখনও খেয়েই যাচ্ছে। কি মনে করে বড় ভাই উঠে পড়লো। কারণ শব্দটা শুনেই মনে হচ্ছিলো কে যেন আয়েশ করে কিছু চিবিয়ে খাচ্ছে।

 

সেটা ছিল আবার পূর্ণিমার রাত। বড় ভাই গুটি গুটি পায়ে পাশের ঘরে চলে এলো। চাঁদের আলোয় ভালই দেখা যাচ্ছিলো। টেবিলের উপরে চোখ পড়তেই বড় ভাইয়ের পিলে চমকে গেল! কোথায় খাবার? পানীয় দেয়ার গ্লাস ভর্তি রক্ত, আর প্লেটে সব্জির পরিবর্তে মানুষের আঙ্গুল দেখা যাচ্ছিলো। ভয়ের এক শীতল স্রোত বয়ে গেল তার মেরুদন্ড দিয়ে। যা বোঝার বুঝে গেল এক মুহুর্তে। যা হবার হয়ে গেছে। আর কিছুই করার নেই। মেঝের দিকে চোখ গেলো। ওর বোনটি আয়েশ করে চিবিয়ে চিবিয়ে ওর মেঝ ভাইয়ের কলিজা খাচ্ছিলো। বোনটি তার বড় ভাইকে দেখে নির্বিকার ভাবে বললো, ‘ভাইয়া তোমার ঘুম ভাল হয়েছে তো? আমার আর একজনকে খেতে হবে। সেটি খেয়ে ফেললেই আরপর আমি একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে যাবো’।

 

একথা শুনে বড় ভাই আর কালবিলম্ব না করে এক লাফ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসল। যে করেই হোক এই শিয়াল দানবের হাত থেকে জান বাঁচাতে তো হবে। চাঁদের আলোয় সে পথে দৌড়ে বের হয়ে আসলো। বোনও সাথে সাথে ভাইয়ের পিছু নিলো। বড় ভাইয়ের তখন সেই ঋষির উপদেশ মনে পড়লো। হাত থেকে সাদা বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। দুই ভাই বোনের মধ্যে সাদা ধোঁয়ার একটা আস্তরণ তৈরী হল। এতে করে বোনটা কিছুক্ষণের জন্য ভাইকে দেখতে পেলো না আর ভাইটাও কিছুদূরে আরও দৌড়ে সরে গেল। ততক্ষণে বোনটিও ধোঁয়ার আস্তরণ ভেদ করে চলে এসেছে। এবার ভাইটি উপায় না দেখে হাতের নীল বোতলটা ছুঁড়ে দিলো। এবার দুই ভাই বোনের মাঝে একটা বড় খাল তৈরী হলো। এবার বোনটিকে অগত্যা পানিতে নেমে পড়তে হলো। কোনমতে সে সাঁতার দিয়ে এপাশে এসেছে। তখন ভাইয়ের হাতে শেষ লাল রঙের বোতলটা রয়ে গেছে। বোনটি যখন প্রায় ভাইকে ধরে ফেলেছে, তখন ভাইটি শেষ বোতলটিও ছুঁড়ে মারলো। এবার ওর বোনের সামনে প্রকান্ড একটা আগুনের কুন্ডলী তৈরী হলো। ভাইয়ের চোখের সামনে দানব বোনটি পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেল। ভাইটির অসহায় চোখে সে দৃশ্য দেখা ছাড়া আর উপায় ছিল না।

 

সব পুড়ে যখন ছাই হয়ে গেল, তখন সেই ছাইয়ের ওখান থেকে গুনগুন শব্দ করে একটা মশা উড়ে চলে গেল। এরপর থেকে বলা হয়ে থাকে, শেয়াল আর মশা এরা কেউই ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না।             

 

 

Author's Notes/Comments: 

১৭ই ফেব্রুয়ারী ২০২১ গল্প সংগ্রহঃ উম্মে রিফাত আরা (রিনতি)

View shawon1982's Full Portfolio