১৭ মে ২০২০

** ‘কি রে দোস্ত, ভাল আছিস?’- বন্ধুত্বঃঅভিনয়


জীবনের প্রয়োজনে কত রকম অনুপাতের সম্মুখীন হতে হয়। কতগুলো বিপরীতমুখী জিনিসের অনুপাত। এরা পরস্পর পরস্পরের বিপরীত ধর্মী হলেও এদের কোনটাকেই কেন জানি জীবন থেকে বাদ দেয়া যায় না। ভাল-মন্দ, ভালবাসা-ঘৃণা, বন্ধুত্ব-অভিনয় এরকম আরো কত কিছু। এই লাইনটা লেখার পরে নিজেই একটু অবাক হয়েছি। প্রথম দুইজোড়াকে Antonym pair বলা গেলেও বন্ধুত্বের সাথে অভিনয় শব্দটা কোনভাবেই কোন ব্যকরণেই বিপরীত শব্দের তালিকায় যায় না। কিন্তু আমার তালিকায় এসে গেল কিভাবে যেন। থাকুক। আমি এমন কোন ব্যকরণবেত্তা নই যে আমার কথায় কিছু আসবে যাবে। যা লিখছি সব তো জীবন থেকেই লিখছি।

 

ছোটবেলা থেকেই আমার প্রচন্ড একটা মানসিক ব্যধি আছে যা আমাকে আজও স্বাভাবিক মানুষে পরিণত করেনি। আমি প্রায়ই মনে করি, আমি মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ নই। অনেকগুলো সুতো ছেঁড়া একটা ব্যাপার আছে। আর এই সুতোছেঁড়া ব্যাপারগুলোর জন্যই জীবনের নকশার প্রতিটা সূচের ফোঁড়ে একটা বৈসাদৃশ সমন্বয় দেখি সবসময়। আমি যদি আমার জীবনে থেকে এসব বৈচিত্র্যময় বৈসাদৃশতা দূর করতে পারতাম, তাহলে মনে হয় আমি জীবনে আরো একটু সুখী হতে পারতাম। আমি অভিনয় করতে পারি না। সেটাই আমার জীবনকে অনেক জায়গায় বন্ধুর করে দিয়েছে। যেখানে চিন্তা করার কোন দরকার নেই সেখানেও আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে প্রতিনিয়ত। আমি যেহেতু আমাদের সমাজের আশপাশের মানুষগুলোর মত স্বাভাবিকতায় অনেক কিছুই মেনে নিতে পারি না, সেজন্য অবলীলায় আমি নিজেকে বলে দেই, আমি আসলে কোন ভাল মানুষ নই। আমি স্বাভাবিক নই, আমি অভিনেতা নই। আমার সবটুকুই প্রকাশিত, আমি মনে মনে যা চাই অকপটে সেটা স্বীকার করে ফেলি। এজন্যই আমি দোষী।

 

নাটক সিনেমা দেখতে দেখতে মনে হয়, এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি অভিনয়টা শিখতে পারতাম! মনে হয় যদি আমিও নাটক করতে পারতাম, কেমন হত! হল না তো, আমি অভিনেতা হতে পারলাম না। কিন্তু আমার আশপাশের শত সহস্র অভিনেতার অভিনয় দেখছি আর দেখতে দেখতে এতটাই বিমোহিত হয়ে পড়ছি যে, আমি আসবে ভুলেই যাচ্ছি যে কোনটা অভিনয় আর কোনটা বাস্তবতা।

 

‘বন্ধু’ নামক জিনিসটা আমার সবসময়ই অনেক পছন্দের। সেই স্কুল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে যখন ইন্টারনেট চেনা শুরু করলাম, তখন থেকেই Yahoo Messenger এর চ্যাটিং করা দিনগুলোর কথাও মনে পড়ে। স্কুল, কলেজ ভার্সিটির সহপাঠী বন্ধুরা তো আছেই, এরপরে নিজের সামনে খুলে গেল ভিন্ন একটা জগত। সেটাকেই এখন আমরা ভার্চুয়াল জগত বলছি। ভার্চুয়াল হতে হতে, সেখান থেকে কিছুটা কিঞ্চিত বাস্তবতা। আবার বাস্তবতা থেকে আবার কিছুটা ভার্চুয়ালে।  এভাবেই দিন চলে যায়। চেনা জানা হতে থাকে কত রঙ্গের মানুষের সাথেই এই ‘মানুষরুপী’ আমার। নিজেকেই এখন মানুষরুপী মুখোশধারী ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। আমার আশপাশের সবাই বাস্তব। শুধু আমি একাই অবাস্তব, কারণ আমি অভিনয় জানি না। আমার কিছু পেতে ইচ্ছে করে।  

 

ভার্চুয়াল জগত থেকে, কিংবা কিছুটা বাস্তবতা থেকে কত রকম মানুষের সাথে পরিচয় হয় হচ্ছে। অনেকের সাথে মিশে, কথা বলে, চ্যাটিং করে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে বাহ, এইতো আমার বন্ধু! মনের আবেগে কত কথা বলছি। আস্তে আস্তে বেড়ে যায় আশা আকাঙ্খার বিপজ্জনক পরিসীমা। কথা বলা মানুষটাকে বন্ধু মনে হতে থাকে। ভাল লাগে ভাবতে আমার বন্ধুই তো। ছোট-বড় বয়স কোন ব্যাপার না। সবার সাথেই আমি ভীষণ বন্ধুবৎসল যে। যারা আমাকে ‘ভাই’ বলে, তাদেরকেও আমার ভাই মনে হয়। মনে হয় ওরা ছোট হলেও আমার বন্ধু। আমার ভীষণ প্রিয়। কথা বলি হয়ত দিনের কিছু সময়, কিন্তু আমার অবসর শুধু নয়, আমার কাজের মাঝেও আমার মনের গহীনে তাদের জন্য এক অপরিসীম ভাললাগা ভালবাসা কাজ করতে থাকে। শত কাজের মাঝেও, সেই ইন্টারনেটে মাঝে মাঝে টোকা দেই, ‘কেমন আছ ভাই’? ‘কিরে দোস্ত কেমন আছিস’? ‘কোথায় আছিস?’ ‘দোয়া করিস আমার জন্য’।

 

মজার কথা কি জানেন? বেশীরভাগ এসব বন্ধুত্ব আর ভালবাসা কি এক দৈবলে যেন এক তরফা হয়ে যায়। ৯৯% কিংবা হয়ত তার চেয়েও বেশী সময় এমন ঘটে যে, ‘কেমন আছ’, কথাটা আমার তরফ থেকেই আগে যায়। এই কথাটা আমার কাছে কখনও ফেরত আসে না। উল্লেখযোগ্য সময়েই, কখনও আমার কাছে নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া, কেউ জিজ্ঞাসা করে না, ‘কি রে কেমন আছিস’? শতাংশের ঘরে আমি ১% কিন্তু বাকী রেখেছিলাম। খেয়াল করেছেন? কারণ ব্যকরণে ‘ব্যতিক্রমী’ বলে একটা ব্যাপার আছে। ব্যতিক্রম একটু থাকে, কিন্তু সেটার পরিমান যৎসামান্যই।

 

বন্ধুর সাথে অভিনয়ের যে একটা ব্যাপার আছে, একটা মেকী ব্যাপার যে যুক্ত আছে, সেটা বুঝতে পারি না নাকি নিজেকে ইচ্ছে করেই বুঝতে দেই না, সেটা আমার বোধগম্য হয় না। কারণ এই ‘বন্ধু’ নামক মায়াজালের ভুলে আমি বারবার হাত বাড়িয়ে দেই, আর অগ্নিহগ্ধ হাতটা যখন আমার কাছে ফেরত আসে, আমি ভীষণ অবাক হয়ে ভাবি, আশ্চর্য আমার হাতটা এত কুৎসিত! অন্য হাতটা আবার এগিয়ে দেই। টাইপ করতে থাকি, ‘ভাই, ভাল আছ তো?’, ‘দোস্ত ভাল আছিস তো?’, ‘কি রে দোস্ত খবর কি তোর’?  

 

View shawon1982's Full Portfolio