১৬ মে ২০২০

**নন্দ ঘোষের যত দোষ সমাচার   


**শৈশব ও কৈশোর যেভাবে গিয়েছে-৭


পরিবারের বড় সন্তান যারা, কিংবা বড় বৌ যারা তাদের উপরে কি আইন, কানুন আর শাসনের বেড়ী সমাজগত ভাবে পরানো থাকে?  বড় সন্তানগুলো মনে হয় শাসনের অদৃশ্য-বেড়ী পায়ে দিয়ে জন্মায় আর বড়-বৌ গুলা বিয়ের কাবিন নামায় সই করার সাথে সাথে মনে হয় পায়ে একটা বেড়ী পরিয়ে দেয়া হয়। খেয়াল করে দেখুন আমি বড়-জামাতা বলি নি! কারণ বড় জামাতা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেবতার আসনে থাকেন, যদিও সে যৌতুক নিয়েও বিয়ে করে থাকেন এবং যদি তার স্ত্রীকে ডিভোর্স না করে থাকেন অথবা অন্য কোন বড়-অপরাধ না করে থাকেন। আমার নানাবাড়ী দাদাবাড়ী থেকে শুরু করে অনেক পরিবারেই এটা দেখেছি আমি। বড়-বৌ আর বড়-জামাতা দুইজনই একটা পরিবারের সন্তানদের সাথে বৈবাহিক সূত্রের মাধ্যমে এলেও আমার চোখে দেখা পরিবারে এ দুইয়ের অবস্থান দুই মেরুতে! বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বড়-জামাতা যেমন আদর আপ্যায়ন পান ঠিক তেমনি বিপরীতে বড়-বৌ ততখানিক বা ততধিক বেশী গঞ্জনার শিকার হন। অবশ্য সবাইকে একই কাঠগড়ায় দাড় করাচ্ছিনা আমি। ব্যতিক্রম থাকেই। কিন্তু ব্যতিক্রম আর নিপাতনে সিদ্ধ কোন নিয়ম না।

 

ছোটবেলা থেকেই আমার গায়ে একটা ‘ভদ্র-ছেলে’ ট্যাগ লাগানো ছিল। আর সেতা রক্ষার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছি। ভদ্র ছেলে কিসে কিসে হওয়া যায় তার সবকিছুই নিজের মধ্যে আয়ত্ত করতে চেষ্টা করেছি প্রতিনিয়ত। সেগুলোর জন্য আমার পারিপার্শ্বিকের মানুষের কাছে কিছু ‘গালভরা’ সো কলড বাহবাও পেয়েছি একসময়। অবশ্য যারা আমাকে তখন বাহবা দিতো, পরবর্তীতে সামান্য সামান্য কারণে তাদের চোখ ওলটানো দেখেছি বহুভাবে, বহুসময়ে। হাজার চেষ্টা করেও শৈশবের বাহবা ধরে রাখতে পারিনি মধ্য বয়সে এসে।

 

শৈশবের এই বাহবা আমার কাছে ‘কচু পাতার পানি’র মত ছিল। মধ্য বয়সে এসে ঝরে গেছে। আমি ধরে রাখতে পারিনি আমার শৈশবের শেখা সেই মেকী লৌকিকতাগুলো। মানুষ অতিদ্রুত বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে কিন্তু আমার অনেক দেরী হয়েছে। শৈশবের ‘ভদ্র-ছেলে’ ট্যাগটা যে এত দ্রুত নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে সেটা বুঝতে পারিনি। যখন পেরেছি তখন আমি আর ভাল-ছেলেটা নেই আর। অবশ্য আমার গায়ের থেকে ভদ্র-ছেলে, ভাল-ছেলে এসব ট্যাগ দূরীভুত বা বাষ্পীভূত অনেক দ্রুত হয়ে গেছে তার কারণ হল, আমার গায়ে বড়-ছেলে নামক আরেকটা বেড়ী-পরানো শেকল আছে। আমার পিতা-মাতার আরো একটা ছেলে আছে। তার গা থেকে ভাল-ছেলে ট্যাগটা কমছে না, বরং উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হচ্ছে। আমারটা কমছে আর ওরটা বাড়ছে একদম গাণিতিক ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কের মতই। ব্যস্তানুপাতিকের এই সূত্র যে যার জীবনে যত দ্রুত অনুধাবন করতে পারে তার জন্য মনে হয় ততই মঙ্গল।

 

শৈশবে আমাদের একটা জিনিস খুব সুকৌশলে সেখানো হত। ‘ছোটদের হাতে টাকা থাকতে নেই। টাকা দিয়ে কি করবা তোমরা? তোমাদের সবকিছু তো আমরাই কিনে দেই। কি লাগবে বল? হারে টাকা রাখলে হারায়ে যেতে পারে। দাও আমাদের কাছে দাও। যা লাগে আমরা দিব’। এমন কথা শুনতাম আর টাকাগুলো তুলে দিতাম অভিভাবকদের হাতে। উনারা টাকাগুলো নিয়ে নিতেন, আর পরে অন্যদের শুনিয়ে দিতেন, ‘দেখেছ, ও না টাকা একদম হাতে রাখতেই চায় না। কিছু লাগলে আমাদের কাছে এসে নিয়ে যায়’। বেশ ভাল কথা। বয়সের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এটা মেনে নেয়া যায়। ঠিক আছে ছোটদের হাতে টাকা না থাকাই ভাল। কিন্তু সেটা শৈশবের কোন সময়ে এসে? সেটা কি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে এসেও? ভার্সিটিতে উঠেও? সারাক্ষণ হাত পেতে পেতে চাইতে হবে? যতক্ষণ হাত পেতে চাইবো ততক্ষণ আমি ভাল ছেলে? এরপর যখন ক্রমবর্ধমান হারে বড় হতে থাকি, স্কুল, কলেজ এরপর ভার্সিটি- আস্তে আস্তে টাকা দেয়ার সাথে যুক্ত হতে থাকে নতুন কিছু কথা। ‘এখন বড়ো হচ্ছো, ঘরের কথা চিন্তা কর, আমাদের বয়স হয়ে যাচ্ছ, সব দায় দায়িত্ব নিতে হবে, এই বয়সের ছেলেরা তো নিজেদের খরচ নিজেরা চালায়, ওমুক আঙ্কেলের ছেলে টিউশনি করে, তুমি তো কিছু করলেও পারো, ওমুকে টিউশনি করে ডিস অ্যান্টেনা কিনে ফেলেছে, তমুকে টিউশনির টাকা সংসারেও দেয়’।

 

ছেলেটা বড় হতে থাকে, আর তার দিয়ে দায়িত্বের জোয়াল আসতে থাকে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দায়ভার অবধারিত ভাবে বড়টার ঘাড়ে বর্তাবে। অথচ অনেক পরিবার এটাও চিন্তা করে না, ছেলে বা মেয়ে যদি বড় হয়, অনেকের সাথে মিশতে হয়, একসাথে বসে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপার থাকে, সেখানেও টাকা পয়সা লেগে যেতে পারে। সবসময় বাসায় চাইতেও যেমন লজ্জা লাগে তেমন হাতে টাকা পয়সা না থাকলেও বন্ধুদের সামনে ছোট হয়ে থাকতে হয়। আমি কিন্তু সেই পরিবারের কথা বলছি না যারা আর্থিক ভাবে অসচ্ছল। আমি তাদের কথা বলছি যাদের যথেষ্ট সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও এসব দেখতে বা শুনতে হয়েছে। এরপরেও কোন কারণে টাকা চাইতে গেলে হাজার গন্ডা কৈফিয়ৎ দেয়া লাগে।

 

আমি আমার পরিবারের যেমন বড়-ট্যাগ ওয়ালা ছেলে তেমনি আমার স্ত্রীও ছোট-ট্যাগ ওয়ালা। স্বাভাবতই আমাদের আচরণের মধ্যেও কিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল। আমি শান্ত তো সে চঞ্চল, আমি ঘরকুনো তো সে বাইরে যেতে ভালবাসে। এমন আর কি! কিন্তু ঐযে পরিবারের বড়-বৌ যে! এজন্য আমার করা দোষগুলোর একটা একটা করে তাকে শুনতে হয়েছে এবং তাকেও আমার সাথে সমহারে দোষের ভাগী হতে হয়েছে। অনেক কিছুই আমার কানে সে কখনও তোলেনি। আমি বারংবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও না। ছোটবেলা থেকেই আমার যেমন জবাবদিহিতা দেয়া অভ্যাস, বাসা থেকে বাইরে বের হলেই বড়দের জানিয়ে যাওয়া অভ্যাস ছিল, আমার স্ত্রীর কাছেও ঠিক একই রকম আচরণ আশা করা হত। তখন কিন্তু ভাবা হয় না, মেয়েটা একটা বাড়ির ছোট মেয়ে ছিল। আর দুই পরিবারের সন্তানদের আচার আচরণ ও এক হবে এটা আশা করা যায় না। সে চেষ্টা করেছে, তবুও অনেকের মন ভোলাতে পারেনি।  

 

কাছের একজন মানুষের কাছে তাদের বাসার কথা শুনেছি। আমাকে যে বলেছে সেও বাড়ির বড় ছেলে ট্যাগধারী। বাড়ি থেকে বের হবার জন্য জবাবদিহিতার সম্মুখিন হতে হয়েছে তাকেও এবং তার স্ত্রীকেও বারংবার। ক্ষেত্র বিশেষে উগ্র মেজাজের কিছু কথা, প্রত্যক্ষ এবং অন্যের মাধ্যমেও শুনতে হয়েছে বাড়ির বড় বৌটিকে। পক্ষান্তরে সেই পিতারই অন্য ছেলে এবং তার স্ত্রীকে সেটা বলেও কোন কাজ হয়নি। রাজহংস-হংসীর মত গ্রীবা উচিয়ে, বড়দের কথা অমান্য করে তারা যখন তখন না বলে ঘরের বাইরে চলে গেছে। রাত দিন সময়ের কোন ব্যাপার ছিল না। সেই পিতা তার আপত্তির কথা বলতে গিয়ে উল্টা কথা শুনেছে তার ছোট বৌমা এবং ছোট ছেলের কাছে যুগপৎ ভাবে। উল্টা শুনিয়ে দিয়েছে, আমাদের যখন খুশি আমরা বাইরে যাব, আপনার কি?

 

একই পরিবারের কাহিনি। একই সাথে থাকে তারা। এখন সেই ছোট ছেলে আর তার বৌয়ের বাইরে যাওয়া নিয়ে শশুর শাশুড়ীর কোন আপত্তি নেই। ‘ওরা তো একটু এমনই’, এই বলেই তারা সন্তুষ্ট আছেন। সংসারের প্রতিটি জিনিস, ছোট ছেলে আর তার বৌকে দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন সেই পিতা মাতা। যা ইচ্ছে তাই করার স্বাধীনতা আমাদের দেশের অনেক পরিবারই ছোটদের দিয়ে দিলেও গলায় জবাবদিহিতার বেল্ট পরানো থাকে বড়োগুলারই। ছোটগুলা একচ্ছত্র স্বাধীনতা উপভোগ করবে, আর বড়গুলা জবাবদিহিতা করতে করতে নন্দঘোষে পরিণত হবে। সব দোষ যার সেই তো নন্দ ঘোষ।   

 

View shawon1982's Full Portfolio