৬ মে ২০২০

****{ যৌন নিপীড়ন ও শৈশব }****

**** Childhood Sexual Abuse ****

 

**শৈশব ও কৈশোর যেভাবে গিয়েছে-৩

 

যৌন নিপীড়ন নিয়ে এখনকার পিতা মাতার মধ্যে কিছুটা সচেতনতা বেড়েছে বলে প্রতীয়মান হলেও সেটা কত শতাংশে সেই ব্যাপারে আমার একটু না অনেকটাই সন্দেহ আছে। এটা আমাদের সমাজের, পরিবারের এমন একটা কলঙ্কিত অধ্যায় যে এটাকে ‘লজ্জা’ নামক লজ্জাজনক খোলসে আবৃত করার একটা স্বপ্রনোদনা কম বেশী সব পরিবারের মধ্যেই লেখা যায়। যেসব পরিবারের শিশুরা বড়দের দারা যৌন বিকৃতির স্বীকার হয় তাদের বেশীর ভাগই থাকে Introvert Nature এর বা সহজ বাংলায় যাদের আমরা বলি ‘মুখচোরা’ অথবা ‘ঘরকুনো’। Paedophilia বা ‘শিশুকাম’ বিকৃতির মানুষগুলোর কাছে ছেলে বা মেয়ের কোন বাছবিচার থাকে না। মুখচোরা একটা বাচ্চা হলেই চলে। কারণ এই জাতীয় বাচ্চাদের কে Molest করা বা তাদের উপর ‘আদর’ এর আবরণ চড়িয়ে বিকৃত যৌনাচার চালানো বেশ সহজ। এসব বাচ্চারা লাজুক থাকে এবং বয়স কম হবার কারণে সেটাকে ‘আদর’ মনে করে চুপ থাকে। আর এই বিকৃত মানসিকতার মানুষগুলো বাচ্চাদের কে এমনভাবে ‘আদর’ করে, এটা ওটা দিয়ে ভুলিয়ে রাখে, যে বাচ্চারা বুঝতেই পারে না সে কিসের শিকার হতে যাচ্ছে। যারা কিছুটা বুঝতেও পারে, তারা অনেক সময় বাবা মায়ের কাছ থেকে বকা খাবার ভয়ে সিটিয়ে থাকে এবং এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ থাকে। এজন্য দায়ী বাবা মায়ের অসচেতনতা এবং তাদের সাথে সন্তানের মানসিক দূরত্ব। যেসব পিতা মাতার কাছে সন্তানের লেখাপড়া করাটাই একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে, সেসব পিতা মাতাও এসব দেখতে পান না এবং সন্তানের সাথে ক্রমাগত ঘটতে থাকা এই বিকৃত যৌনাচার সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ বেখবর থাকেন। অনেক বাবা মা টের পেলেও, ‘লোকে কি বলবে’ এই ভেবে সম্পূর্ণ চেপে যান, সন্তানকে চুপ থাকতে বলেন, এবং এর ফলে এই বিকৃত মানুষগুলো সমাজে অনেক সাবলীল ভাবে ঘুরে বেড়ায় এবং এর কোন স্থায়ী প্রতিকার হয় না।

 

ভূমিকা অনেক হল। আমি আজ লিখতে বসেছি আমার নিজের জীবনের ঘটনা বলার জন্যই। ছোটবেলা থেকেই আমি প্রচন্ড ঘরকুনো আর মুখচোরা ছিলাম। গায়ে ধুলা লাগা পছন্দ করতাম না, রাস্তায় বা মাঠে ঘাটে খেলা পছন্দ করতাম না। এই ব্যাপারটা আমার পারিপার্শ্বিকের বড়দের অনেক হাসি আর আনন্দের খোরাক জুগিয়েছিল। এখনও উনারা আমাকে সামনে পেলে পুরনো স্মৃতিচারণ করে প্রাণ খুলে হাসাহাসি করেন। আমি এই করতাম আমি সেই করতাম, আরো কত কি! কিন্তু একটা ঘরকুনো ছেলেকেও যে Motivate করে বাইরের কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত করা উচিত বা তাকেও যে সমবয়সী ছেলেপেলেদের সাথে মিশতে দেয়া উচিত, নিজেদের নিয়ে যাওয়া দরকার, সেটা উনারা কখনও মনে করেন নি। আর অভিভাবকদের এই মানসিকতাই অনেক ঘরকুনো বাচ্চাকে আরো অনেক বেশী ঘরকুনো করে দেয়, মুখচোরা বানিয়ে দেয়, যেমনটা আমার হয়েছিল। এই জাতীয় বাচ্চারা তাদের বাবা মায়ের হাতের চাবি দেয়া পুতুল বা Puppet  এ পরিণত হয়ে যায়। বাবা মায়ের কথার বাইরে এক চুলও কিছু করতে পারে না। কারণ তাদের মধ্যে সেই মেরুদন্ডই তৈরী হতে দেয় না তাদের আশেপাশের লোকগুলো। চাই সেটা গোচরে হোক কিংবা অগোচরে। আর পরিবারের বা সমাজের মধ্যে ওঁত পেতে থাকা বিকৃত যৌনাচারী শয়তান গুলোর খোরাক হয়ে যায় এই সব মুখচোরা ছেলে মেয়ে গুলো। আমার ক্ষেত্রেই ঠিক সেটাই হয়েছে। প্রবাসে এবং সদ্য প্রবাস থেকে এসে দেশেই আমি দুইজন বিকৃত যৌনাচারীর বারংবার হামলার শিকার হয়েছি।

 

১৯৮৮-১৯৮৯ সাল ছিলাম সৌদি-আরবের ‘আর-আর’ নামক শহরে বাবার কাজের সুবাদে। সেখানে যেই বাসায় আমরা থাকতাম, সেখানে আরো দুইজন বাংলাদেশী পুরুষ ছিল। তাদের কে আমি আঙ্কেল বলতাম। দুই আপন ভাই। নাম ছিল আনিস আর হাফিজ। বাড়ি বরিশালে। আমার বয়স তখন ছিল ছয় বছর। সবার চোখেই প্রিয় ছিলাম। আমার যাবার দুইটাই যায়গা ছিল। হয় আমি আমার বড় খালার বাসায় থাকবো, অথবা আমাদের নিজেদের বাসায়। আরব কোন ছেলেপেলের সাথে আমার মেশা একদম বারণ ছিল। কোন অবস্থাতেই আমরা বাসার বাইরে যেতে পারতাম না। আনিস আঙ্কেল চাকরী করতো কিন্তু হাফিজ আঙ্কেল কিছু করতো কিনা সেটা এখন মনে করতে পারছি না। দুপুর বেলা আমার আব্বু থাকতো তার ওয়ার্কশপে কাজে ব্যস্ত। আম্মু দেখা যেত দুপুরে বিশ্রাম করতো, কিন্তু আমি ঘুমাতাম না। আমি খেলাধুলা করতাম। আমি খুব সহজেই হাফিজ আঙ্কেলের(!) টার্গেট হয়ে গেলাম। আদর তো সবাই করতো। সেই আদরের সুযোগে এই হাফিজ আমাকে তার ঘরে নিয়ে যেতে থাকে এবং সেখানে সে বের করে নিয়ে আসে তার বিকৃত কদর্য নগ্ন মানসিকতা এবং দেহ দুটোকেই। একবার দুইবার না, দফায় দফায় সে চালাতে থাকে তার এই বিকৃত যৌনাচার। কারণ সে জানতো, মুখচোরা স্বভাবের কারণে আমি কাউকে বলে দিব না। হাফিজ এখন কোথায় আছে কিভাবে আছে আমি জানি না। আমরা দেশে আসার পরে একবার তার শুভাগমন(!) হয়েছিল আমাদের সেনপাড়া বাসাতে। আমি স্কুল থেকে বাসায় ফিরে তাকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। আম্মুর বারংবার বলা সত্ত্বেও সেদিন আমি হাফিজ(!) আঙ্কেলের সামনে যাইনি কিংবা তার আনা কিছু খাই নি। আমার আম্মু এটাকে আমার বাচ্চাসুলভ আচরণ মনে করেছিলেন। কিন্তু আমার কাছে সেদিনও হাফিজের সেই বিকৃত আচরণ যেভাবে মনে ছিল, এখনও ঠিক সেভাবেই মনে আছে।

 

১৯৮৯ সালের নভেম্বরে দেশে চলে আসি। এসে আমরা শ্যামলীতে থাকা শুরু করেছিলাম আমার বড় খালার বাসায়। আমার ছোট খালা তখন শ্যামলীতে থাকতেন। আমরাও তখন একান্নবর্তী হয়ে উনাদের সাথেই শ্যামলীতে থাকতে লাগলাম। সেখানে আমার ছোট খালার ভাসুরের এক ছেলে ছিল। এবারো আমি তার সহজ টার্গেটে পরিণত হয়ে গেলাম। একেবারে হাতের নাগালে ঘরের ভেতরেই। এই একই পদ্ধতি, একই কদর্য রুপে বারবার। আমার সাথে তার বাড়তি মাখামাখি ‘আদর’ কে সবাই স্বাভাবিক(!) আদর বলেই মনে করেছিল। এখানেও একাদিক্রমে চলতে থাকলো সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। দিনের পর দিন। কেউ কিছুই জানলো না। কারণ এসব কথা কাউকে বলতে হয় না, এসব বললে আমাকে মারবে, বার বার আমাকে এইগুলাই সেখানো হত।

 

আমার মানসপটে এই দুই বিকৃত যৌনাচারীর করা যাবতীয় পাশবিকতা স্পষ্টই মনে আছে। সবকিছুই মনে আছে। কিছুই ভুলিনি আমি। এরপর ধীরে ধীরে বড় হয়েছি। চাবি দেয়া পুতুলের মতই লেখাপড়ার এক একটা ধাপ অতিক্রম করেছি। সবার কাছে পরিচিত হয়েছি ‘রোল মডেল’, ‘ভাল ছেলে’, ‘ভাল ছাত্র’ হিসেবে। মনের ভেতর রয়ে গিয়েছিল সব কথাই। যথা নিয়মে ২৭ বছর বয়সে বিয়ে করলাম। শৈশবে যৌন বিকৃতির শিকার অন্য কারো হয় কিনা, সেটা মনোবিজ্ঞানীরাই ভাল বলতে পারবেন কিন্তু আমার সমস্যা হয়ে যেত। আমার স্ত্রী ঠিকই বুঝতে পারতো কোথাও যেন সুঁতো ছেঁড়া একটা ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। আমি তখনও ওকে বলিনি আসলে কি জাতীয়, মানসিক পীড়ন পীড়া দিচ্ছে আমাকে। ও আমাকে বুঝতে চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশে ২০১৩ তে একদম চলে আসার পরে অর্থনৈতিক সমস্যার প্রাক্কালে আমার কিছু মানসিক স্থিরতার সমস্যা দেখা দিল। দ্রুত রেগে যেতাম, অযথা স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যাবহার করতাম। তখনও আমার শৈশবের ঘটা ঘটনাগুলা পীড়া দিত মারাত্মকভাবে। নিজের কাছেই নিজে কেমন যেন হীনমন্যতায় ভুগতাম। আমি আমার স্ত্রীকে অনেকবার ঘটোনাটা বলে দিতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। আমার কাছে বারবার মনে হত ও কি মনে করবে?

 

অবশেষে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে গিয়ে আমি আমার স্ত্রীকে সব কথা খুলে বলি। সে অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে আমার কথা গ্রহন করে করে আমাকে সহজ করে দিল। আমাকে উলটা বলতে লাগলো, এসব কথা তুমি আমাকে আগে বলতে পারতে। এতে তোমার দোষ কি? সে আমাকে খুব সহজ করে নিল। আমি মনের থেকে অনেকটা স্থির হয়ে গেলাম। তবুও আমরা একজন সাইক্রিয়াটিক এর পরামর্শ নিলাম। আমি তার দেয়া ওষুধ কিছুদিন খেয়েওছিলাম। এরপর থেকে ভাল আছি। এখনও কখনও আমার মনের ভেতর পুরানো কথা মনে এলে, অকপটে আমার স্ত্রীর কাছে সেটা বলি, তার পরামর্শ নেই। সে সহানুভুতির সাথে আমাকে সান্ত্বনা দেয়। তার এই সাপোর্ট আমার জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে নিঃসন্দেহে। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

 

আমার স্ত্রী আমাকে শুনিয়েছে তার দুই ঘনিষ্ট আত্মীয়া দুই বোনের কথা। দুই বোনই তাদের পৃহ শিক্ষক দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার ছিল। দুই বোনের মধ্যে ছোটজন Vocal ছিল বা কিছুটা চঞ্চল ছিল। সব কিছু বলে দিতে পারতো। কিন্তু পিঠাপিঠি বড় বোনটা ছিল অনেক বেশী মুখচোরা। এরা  দুই বোনই এক গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তো। ছোট বোনটাকে ঐ শিক্ষক তার উরুতে চিমটি দিত, পড়া না পারলে। আর বড়ো বোনটাকে সুযোগ মত ছোট বোনটার চোখ এড়িয়ে তার যৌনাঙ্গে চিমটি দিত। বড় বোন লজ্জায় এই কথা কাউকে বলেনি কিন্তু ছোট বোনটা উরুতে চিমটি খেয়ে তার মা কে সেই কথা বলে দেয়। তার পরদিন থেকেই সেই গৃহ শিক্ষককে বহিঃস্কার করা হয়েছিল। এমনভাবে শুধু গৃহ শিক্ষক না বরং হোস্টেলে থাকা ছাত্র, লিল্লাহ বোর্ডিং এ থাকা মাদ্রাসার ছাত্র তাদের ওস্তাদদের দারা অহরহ এই ঘটনার শিকার হচ্ছে। আমরা কয়জন এই খবর রাখি?     

 

৩২ বছর লেগে গেল, তবুও আমি বলে দিলাম আমার না বলা কথাগুলো। আমার এইসব বলা উদ্দেশ্য একটাই। আমাদের কোন সন্তান যেন সমাজের এই বিকৃত কালো থাবার শিকার না হয়। আমাদের পিতা মাতাদের উচিত বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই উপযুক্ত টেনিং দেয়া এবং বয়স অনুসারে তাদের কে উপযুক্ত যৌন শিক্ষা দেয়া খারাপ স্পর্শ, ভাল স্পর্শ সম্পর্কে বাচ্চাদের অবগত করা উচিত তাদের বুঝতে শেখার পর থেকেই। বাচ্চাদের সাথে পিতা মাতার এমন বন্ধুসুলভ আচরণ ঘরে ঘরে থাকা দরকার। আমার সন্তান আমার সম্পদ।  আমার সন্তানের দেখাশোনা করা এবং তাদের সবরকম সামাজিক নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব আমারই। আমার সন্তান কার সংস্পর্শে আসছে, কে আমার সন্তানকে স্পর্শ করছে সেটা শেখা এবং তদারকি করার দায়িত্ব আমারই।

 

ব্যক্তিজীবনে আমি এবং আমার স্ত্রী এই ব্যাপারে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করি। আমার বাচ্চাদের চোখের আড়াল করে আমরা কোথাও যাই না। বাচ্চাদের কোথাও ছেড়ে রাখি না। আবার মেয়ের বয়স ৬ বছর। ওকে আমরা এখন থেকেই শেখাই কোথায় স্পর্শ করা ভাল আর কোনটা খারাপ। কে ওকে কোলে নিতে পারবে বা পারবে না। স্কুলে বা অন্য কোথাও ওকে যদি কেউ স্পর্শ করে তাহলে যেন আমাদের বলে দেয়, কে স্পর্শ করেছে, কোথায় স্পর্শ করেছে। আমাদের সবার সন্তানের জীবন কল্যানময় হোক। শুধু লেখাপড়ার চাপে পিষ্ট হয়ে নয় বরং আমাদের সবার সন্তানদের জীবন আনন্দময় হোক। ওদের শৈশব আনন্দের স্মৃতিতে পূর্ণ থাকুক।        

View shawon1982's Full Portfolio