৮ মার্চ ২০২০

অ্যারোপ্লেনে উড়তে আমার ভাল যে লাগে সেটা মনে হয় কিছুদিন আগেই একটা লেখায় বলেছিলাম। ১৯৮৯ সালে সৌদি আরব থেকে ফেরার পরে আবার যখন আমার আকাশে উড়ার সুযোগ হয়, সেটা ১৯৯৯ সালে ঠিক ১০ বছর পরে, আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে মে মাসে। সেটা কোন আন্তর্জাতিক ভ্রমন ছিল না। বরং এক পাইলট আঙ্কেলের সাথে উনাদের রেগুলার ট্রিপে আমি ‘কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের’ একটা এয়ার ক্র্যাফট এ করে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে কক্সবাজার হয়ে পুনরায় ঢাকা সফর করেছিলাম দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যে। সেটা আমার জন্য খুব উত্তেজক একটা ভ্রমন ছিল। ছোট্ট একটা এয়ার ক্র্যাফট! পেছনে যাত্রী আমি একা! খুবই ছোট! আর দুইজন পাইলট! আমার জন্য সবচেয়ে উত্তেজনার যে ব্যাপারটা ছিল সেই সময়, তা হল প্লেনের ভেতর ঢুকে দেখি ছাদটা পুরাই ট্রান্সপারেন্ট! আর জানালার ভেতর ছোট্ট একটা গোল অংশ আছে। জানালার ভেতর জানালা। যেটা খোলা যাবে! প্লেনের জানালা খোলা যাবে! এই চিন্তা করেই আমি উত্তেজনায় ফেটে পড়লাম মনে মনে! আমাকে পেছনে বসিয়ে আব্দুল খালেক আঙ্কেল, আমাকে একটা হেডফোন ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা কানে দিয়ে তুমি আমাদের কথাবার্তা শুনতে পারো ইচ্ছা হলে। সময় মত প্লেন উড়াল দিল, আমি ছোট্ট গোল জানাল খুলে দিয়ে মেঘের উপরের ঠান্ডা হাওয়া খেতে লাগলাম। পকেটে লজেন্স ছিল একটা। সেটা খেয়ে র‍্যাপারটা সেই ছিদ্র দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার লোভ সামাল দিতে পারলাম না!

 

পাইলট আব্দুল খালেক আঙ্কেলের ছেলে আব্বুর ছাত্র ছিল। আঙ্কেল আমাকে নিজে মোটর বাইকে করে আমাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে কুর্মিটোলা নিয়ে গিয়ে আকাশপথে ঘুরিয়ে আনেন। এই আব্দুল খালেক আঙ্কেলের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় আব্বুর অফিসে। নিঃসন্দেহে আঙ্কেল একজন অত্যন্ত জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। আমাকে অনেকগুলো কথা বলেছিলেন সেদিন আব্বুর অফিসে বসে। সবগুলো কথার ফাঁকে আমার একটা কথা খুব প্রকট ভাবে মনে বসে গিয়েছিল। অসাধারণ একটা কথা বলেছিলেন ইংলিশ এ। আমি আঙ্কেলের কথাটা হুবহু মনে রেখেছি এবং সেটা উল্লেখ করছি। Allah is one and Everything is one. এই কথাটার ব্যাখ্যা উনি পরে আমাকে বিস্তারিত করলেন। সৃষ্টিকর্তার যেমন কোন বহুবচন হয় না, উনার যেমন কোন Duplicate হয় না, ঠিক তেমনি উনার প্রতিটা সৃষ্টিই সব একক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এই মহাবিশ্বের কোন দুইটি বস্তুই কখনও হুবহু এক হবে না। আঙ্কেলের এই কথাটার মর্ম আমি সর্বত্র উপলব্ধি করেছি এবং এর আসলেই কোন অন্যথা কোথাও নেই। প্রতিটা বস্তু যেমন আলাদা, তেমনি প্রতিটা মানুষও আলাদা। কোথাও কোন মিল নেই। অর্থাৎ Exactly Identical entities বলে আসলে কিছুই নেই। আঙ্কেলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো সবসময়, আমাকে এত সুন্দর একটা কথা সেখানোর জন্য এবং আমাকে আকাশে ওড়ার সুযোগ দিয়ে এত সুন্দর একটা স্মৃতি দেয়ার জন্য।

 

জীবনে চলার পথে আমাদের অনেক ধরণের মানুষের সাথে মিশতে হয়। কাউকে কাউকে আমাদের অনেক ভাল লেগে যায়। সেখান থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও গড়ে ওঠে কারো কারো সাথে। সেখান থেকে তৈরী হয় আন্তরিকতা, হয়তবা মনের থেকে আত্মীয়তাও! মোটকথা আমি বুঝতে চাইছি, ভাললাগা থেকে একজন মানুষের সাথে আত্মার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উঠতেই পারে। দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের চিন্তা ধারায় মিল থাকে। অনেক কিছুই মিলে যায়। কিন্তু সেটা অনেক কিছু পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। সবকিছুতে নয়। কারণ দুইটা মানুষ কখনই হুবহু এক হয় না। ঠিক তেমনি একজন মানুষ কখনও আরেকজনের হুবহু প্রতিরূপ বা প্রতিবিম্ব হতে পারে না।

 

আমি হয়ত কাউকে আমার প্রতিবিম্ব ভেবে বসে আছি। কিন্তু আদতে সেটা নয়। আমার প্রতিবিম্ব হতে হলে আমার সামনে একটা আয়না থাকতে হবে। আয়না না দিয়ে যদি মাঝখানে একটা স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে দুইজন দুইপাশে দাঁড়াই, তাহলে কিন্তু কেউ কারো প্রতিবিম্ব হয় না। আমাদের মনের চিন্তাধারার আর বাস্তবতার বিস্তর ব্যবধানটা মনে হয় এখানেই। আমি যেটাকে আয়না ভেবেছিলাম, সেটা আসলে আয়না ছিলই না। ছিল একটা স্বচ্ছ কাঁচের আড়াল। আর ওপাশের অবয়বটা, যেটাকে আমি আমার প্রতিচ্ছবি ভাবছিলাম, সেটা কখনই আমার প্রতিচ্ছবি ছিল না, ছিল একটা মূর্তিমান ভিন্ন মানুষ। একটা ভিন্ন সত্ত্বা। কাঁচ ভেঙ্গে গেলেই সেই মানুষটা ধরা ছোয়ার মধ্যে চলে আসে। প্রতিবিম্ব বাইরে থেকে স্পর্শ করা যায়, ধরা যায় না।  

View shawon1982's Full Portfolio