২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০

চটপটি খাবার জন্য আমার মাঝে মাঝে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। যেমন গতকাল হয়েছিল। আসরের নামাজ মাসজিদে পড়েই সোজা গেলাম চটপটির দোকানে। মাসজিদের একদম গেটের সাথেই। ওমা দূর থেকে দেখি আমার এক চাচা-শ্বশুর বসে আছেন। উনার সামনে বসে চটপটি খাব? লজ্জায় উনাকে দেখা না দিয়ে আমি সরে আসলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি উনি উঠে চলে গেলেন। আমি আবার দোকানে গেলাম কিন্তু হতাশ হলাম। কারণ ওদের চটপটি বানানোর আয়োজন এখনও শেষ হয়নি। অগত্যা কি আর করা! বাসায় ফিরে একটা গল্পের বই নিয়ে বসলাম বুদ্ধদেব গুহ’র লেখা ‘বাসনাকুসুম’ বইটা। মাঝপথে আছি। পড়ার চেষ্টা করেও মন বসাতে পারছিনা। দুইটা কারণে! এক বেদম মশার কামড় আর আমার সেই আকুন্ঠ চটপটি তৃষ্ণা! কিছুক্ষণ কেটে গেল! নাহ! আর তো পারা যায় না! এতক্ষণে নিশ্চই চটপটি এসে গেছে। আমি পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে আবার ছুট দিলাম দোকানে! এইতো এইতো! এবার শুরু করেছে। আমাকে আর পায় কে! বসে পড়লাম একটা টুল নিয়ে। ওরা আমার ঝাল খাওয়ার মাত্রা সম্পর্কে ভালমত জানে। আমাকে দেখেই চটপটি বানাতে বসে গেল বেশী করে ফুচকা ভাঙ্গা দিয়ে আর অবশ্যই অনেক বেশী ঝাল দিয়ে। ওদের দোকানে ওরা নুডুলস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস, চিকেন ফ্রাই এসবও বিক্রি করে। একটা ছোট গাড়িতে ওদের সরঞ্জাম সব সাজানো থাকে। আমার হাতে দিল বাটি ভর্তি চটপটি। আমি আয়েশ করে খেতে লাগলাম!

 

এক বাটি ইতিমধ্যে প্রায় শেষ করে ফেলেছি। এক বাটিতে কি আর মন ভরে? অগত্যা কি আর করা! দিলাম আরেক বাটির ওর্ডার। এরমধ্যে দেখি আমার পাশে দাঁড়িয়ে সাত কি আট বছরের একটা ফুটফুটে শ্যামলা বরণ গায়ের রঙের মেয়ে হাতে পাঁচ টাকার একটা কয়েন নিয়ে, দোকানদার ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, ‘আমারে পাঁচ টাকার আলুভাজা দেন’! আলুভাজা মানে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস! দোনাকদার জানালো, ‘পাঁচ টাকার আলুভাজা হয়না’। এটা শুনে মেয়েটা হেসে বললো, ‘দ্যান না আমারে পাঁচ টাকার’। দোকানদার আবার অপারগতা জানালো। আমিও জানতাম, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইসের দাম সর্বনিম্ন ১৫টাকা। আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘মেয়েটাকে ১৫টাকারই দাও আর ওর কাছ থেকে টাকা নিও না, আমি টাকা দিয়ে দিব’। এটা শোনা মাত্রই মেয়েটা বললো, ‘থাক লাগবো না আমার’। এই বলে মেয়েটা চলে যাওয়া শুরু করলো। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।

 

তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে বললাম, ‘একি! তুমি আলুভাজা খাবা না?’ মেয়েটা আমাকে যা বললো, সেটা আমি শুনবো তা কল্পনাতেও ভাবিনি। মেয়েটা আমাকে বললো, ‘অন্যের টাকার জিনিস আমি খাই না’। আমি মেয়েটার কথায় ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম মেয়েটা হয়ত খুশিই হবে। হল উল্টা! আমি তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে বললাম, ‘আচ্ছা আমি টাকা দিব না, তুমি পাঁচ টাকারই নাও’। এই কথা বলে আমি দোকানদারের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘ওর পাঁচ টাকা রাখো, আর ওকে পাঁচ টাকারই আলুভাজা দাও’। এই কথা বলে আমি দোকানদারের উদ্দেশ্যে চোখ ইশারা দিলাম। দোকানদার বুঝে গেল। আমি দোকানদারকে ১৫টাকারই ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস দিতে বলেছি আর মেয়েটার কাছ থেকে পাঁচ টাকা রাখতে বলেছি। ইশারায় বুঝিয়েছি বাকী ১০টাকা আমি দিয়ে দিব। আলুভাজা চলছে। আমি ভাবলাম এই ফাঁকে মেয়েটার সাথে একটু আলাপ জমিয়ে নেই।

 

ওর নাম জিজ্ঞাসা করলাম। নাম বললো কুলসুম। স্কুলে পড়ে। ক্লাস টুতে পড়ে কাছাকাছি কোন একটা স্কুলে। ওর বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলাম, বললো ইখলাস নাম। আর ওর বাবা কোন একটা বাসায় দারোয়ানের কাজ করে। এর মধ্যে আমার দ্বিতীয় বাটি চটপটি শেষ হয়ে গেল। আমি বিল দিয়ে উঠে গেলাম। এরপর যখন বাসায় পৌঁছে গেলাম, তখন মনে হল, আহারে মেয়েটার একটা ছবি তুলে রাখলে ভাল হত। পরক্ষণে মনে হল, নাহ! ঠিকই আছে। ছবি তুললে আমি হয়ত এই লেখার সাথে মেয়েটার ছবি দিয়ে দিতাম। এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে যার এত প্রখর আত্মসন্মান বোধ, তার ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়া কোনভাবেই আমার উচিত হত না। ভালই করেছি ছবিটা না তুলে। আজ এইটুকু ছোট্ট একটা মেয়ের মাধ্যমে আমি কত কিছুই না শিখলাম।

 

সাধ্যের অতীত যখন কোন জিনিস হয়ে যায়, সেটার আকাঙ্খা না করাই তো ভাল। মেয়েটা যেমন তার টাকা নিয়েই ফেরত চলে যাচ্ছিল তবুও অন্যের টাকাকে সে ভিক্ষার মত মনে করেছিল। সেজন্য সে অন্যের দেয়া কিছু নিতে চায় নি। গতকাল থেকে আমার বারবার মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। দোয়া করি, আমাদের বাচ্চাগুলোও যেমন আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন হয়। অন্যের টাকায় কিছু খাওয়ার জন্য যেন কখনো লালায়িত না থাকে। অন্যের টাকায় লালায়িত হয়ে ওয়েস্টিন বা র‍্যাডিসনের মত বড়ো যায়গায় গন্ডেপিন্ডে খাওয়ার মধ্যে কোন সন্মান নেই বরং নিজের সামান্য উপার্জনে রাস্তার পাশের দোকান থেকে একটু ডাল, ভাত, ভাজি খাওয়াই অনেক বেশী সন্মানের।

 

তোর জন্য অনেক অনেক দোয়া করি মা কুলসুম! জীবনে অনেক বড় হ তুই মা! সৃষ্টিকর্তা তোকে আমাদের সমাজের কলুষ থাবা থেকে মুক্ত রাখুক। তোর আত্মমর্যাদা বোধ যেন আমার মধেও বিকশিত হয়। সেই প্রার্থনা করছি।

View shawon1982's Full Portfolio