৫ ফেব্রুয়ারী ২০২০

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। যতদূর মনে পড়ে ১৯৯৭ বা ১৯৯৮ সালের কথা। ফাস্টফুড বলতে তখন আমাদের কাছে বার্গারটাই আসল ছিল। পিৎজা খাবার চল তখনও এত ঢালাও ভাবে শুরু হয়নি। কালেভদ্রে একটু বার্গার খেতে পারলেই আমরা খুশি। আমার ছোট খালু তখন ধানমন্ডিতে একটা ফাস্টফুডের দোকান দিলেন পার্টনারশিপে। আমার ছোট খালু অনেক আগে থেকেই একজন প্রতিষ্ঠিত ইলেক্ট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। আমার যে বছর জন্ম উনি সেবার এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ধানমন্ডি সাত মাসজিদ রোডে যখন চালু হল উনাদের দোকানটা তখন আমরা মাঝে মাঝে খুব আয়োজন করে খেতে যেতাম ওখানে। ঐ আর কি! প্রধান আকর্ষণ থাকতো বার্গার খাওয়ার দিকে। দোকানটার নাম ছিল Swiss Castle যতদূর মনে পড়ে নাম এটাই ছিল। একটা বহুতল ভবনের উপরের তলায় ছিল। ছোটখালার বাসায় গেলে মাঝে মাঝে আয়োজন করে যেতাম ওখানে। ছোটখালার গাড়িতে চড়ে যেতাম, রিক্সাতে করেও মনে হয় গিয়েছি।

 

খুব একটা বড় পরিসরে না হলেও দোকানটা একেবারে ছোটও ছিল না। ভেতরের ডেকরেসন বেশ সুন্দর ছিল। ভেতরে আলোক সজ্জা সুন্দর ছিল। খুব উজ্জ্বল না হলেও হালকা আলো ছিল। নানা রঙের ডিম-লাইট জ্বালানো থাকতো। আমাদের জন্য খাবার অর্ডার করা হলে সুন্দর সুন্দর ছোট ছোট বেতের ঝুড়িতে খাবার পরিবেশন করা হত। এখন অনেক ফাস্টফুডের দোকানে যেমন করে। দোকানের ডেকোরেশনের জন্য ভেতরে কিছু পোস্টার লাগানো ছিল। তার মধ্যে একটা পোস্টার ছিল আমাদের কাছে নিষিদ্ধ আকর্ষণের বস্তু। বিশাল বড় একটা পোস্টার জুড়ে দুই মার্কিনি অভিনেতা অভিনেত্রীর চুম্বনের দৃশ্য! যেহেতু বড়দের সাথে যেতাম সেহেতু আড়চোখে দেখে নিতে হত চোখের সুখ! দেখে এমনভাব করতাম যেন দেখিই নাই। পাছে যদি বড়রা দেখে ফেলে আমি কি দেখছি? পোস্টারের গায়ে নায়কের নাম লেখা ছিল। জানি না ভুল হচ্ছে কিনা, যতদূর মনে পড়ে Chris O’Donell ই ছিল। O’ দিয়ে একটা নাম ছিল সেটা আমি একদম নিশ্চিত। যাই হোক, বার্গার খেয়ে নিতাম পেটের সুখ, আর আড়চোখে সেই পোস্টারটা দেখে নিতাম চোখের সুখ! কি ছিল সেসব দিন! যেহেতু দরজার কাছে ছিল পোস্টারটা, তাই দোকানে যেতে এবং বের হতে গেলে অবধারিত ভাবে পোস্টারটা দেখে নিতাম।

 

খাবারের মেন্যু গুলা তো ইংলিশেই লেখা থাকতো। কত বাহারী রঙের নাম ছিল। যদিও আমাদের পছন্দের তালিকায় ঢাউস সাইজের বার্গারই থাকতো কারণ বার্গার না খেলে তো পেট ভরবে না। এদিকে ফাস্টফুড খেয়ে গিয়ে খালার বাসায় গিয়ে যদি আবার ভাত খাই তাহলে কি আর মান ইজ্জত থাকে? কাজেই যদিও চিকেন বা বিফ বার্গার খেতাম কিন্তু একের পর এক সবগুলা নামই পড়ে যেতাম। স্যান্ডুইচ খেলে আমাদের পেট ভরবে না জানি তবুও নামগুলা পড়ে দাম দেখতে তো মানা নাই। আর যেহেতু দাম আমাদের দেয়া লাগছে না সেহেতু এটা কোন ব্যাপার না। খালা দোকানে নিয়ে বলতেন, যার যা খুশি খাও। একটা স্যান্ডুইচের কথা খুব মনে পড়ে। যদিও কোনদিন খাইনি কিন্তু নামটা মনে গেঁথে আছে একেবারে। ওটার নাম ছিল Romance on the Beach! একটা স্যান্ডুইচের নাম ‘রোমান্স অন দ্য বিচ’ কি করে হতে পারে সেটা আমাদের কল্পনার বাইরের বিষয় ছিল। মনে হচ্ছিল এটা বুঝি বড়দেরই খাবার! কোনদিন মুখ ফুটে দোকানটায় গিয়ে বলতে পারিনি যে আমি ‘রোমান্স অন দ্য বিচ’ খাবো! কে কি মনে করে! একদিন আমার এক কাজিন আমাকে বলে বসলো, ‘তোমরা এটার নাম এত বলসো যে খেয়ে দেখলাম!’ কিন্তু আমার ঐ কাজিনের কাছে ‘রোমান্স অন দ্য বিচ’ এমন বিশেষ কিছু মনে হয় নি। আমার ঐ কাজিন আবার ফাস্টফুডের বেশ ভক্ত। সবরকম খাবার সম্পর্কে তার ভাল ধারণা আছে। মনে মনে ভাবলাম, হায় আমার আর খাওয়া হল না সেই বিখ্যাত স্যান্ডুইচ ‘সমুদ্রতটে শিহরণ’। বাংলাটা যদি ঠিকমত না হয় তবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

 

একবার সবার সাথে গেলাম ঐ দোকানটায়। সাথে আমার এক মামাতো বোন ছিলেন। উনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। আমরা একসাথে বার্গার খাচ্ছি। দোকানে বার্গার মাঝখান থেকে দুই ভাগ করে দেয়া হত। আমার নির্দেশনা থাকতো, আমার বার্গার কাটা যাবে না। আস্তই থাকবে। কারণটা কি আমি নিজেও জানি না। এখনও কোন কোন ফাস্টফুডের দোকানে বার্গার খেতে গেলে আমি বলি, কাটবেন না, আস্তই থাক! ওখানে গল্পগুজব করছি আর খাচ্ছি। বার্গার, সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস, কোল্ড ড্রিংস। আমি যেহেতু ভাল খাদক শ্রেণীর মানুষ ছিলাম, আমার কি আর খেতে বেশী সময় লাগে? খেয়ে ফেলে এরপর গল্প করতাম। অন্য কাস্টমারদের খাওয়া দেখতাম। জোড়া জোড়া ছেলেমেয়ে বার্গার খাচ্ছে, একজন অন্যজনকে খাইয়ে দিচ্ছে, চোখে চোখে কথা হচ্ছে, চাপাস্বরে হা হা হি হি হচ্ছে, এগুলা দেখতাম। এসবও দেখতার আর পোস্টারটাও দেখতাম। খেয়াল করে দেখেছি, জোড়াগুলা খুব আস্তে আস্তে খায়। এক কামড় দিয়ে আরেক কামড় কোন জনমে দিবে আল্লাহ মালুম! উনাদের এক কামড় ভার্সাস আমাদের পুরা বার্গার! অনুপাতটা মোটামুটি এমনই ছিল

 

আমি আমার সেই বড় আপুকে বললাম, আচ্ছা মিনু আপু (ছদ্মনাম), এরা এত আস্তে আস্তে বার্গার খায় কেন? উনি খুব রসিক টাইপের মানুষ। আমাকে ছোটবেলায় এই আপু ‘চোখ মারা’ শিখিয়েছিলেন। আমি সমানে উনার সাথে অনেক ছোট থাকতেই চোখ মারা প্র্যাকটিস করতাম। কত সূক্ষ্ম করে চোখ মারা যায়। চোখ পুরো বন্ধ করা যাবে না। এক চোখ সম্পূর্ণ খোলা রেখে আরেক চোখের এক পঞ্চমাংশ (১/৫) পাতা নামিয়ে আবার আগের অবস্থানে নিয়ে আস্তে হবে। এক পঞ্চমাংশের যায়গায় এক ষষ্ঠাংশ (১/৬) বা এক সপ্তমাংশ (১/৭) করতে পারলে আরো ভাল হয়। যে ভগ্নাংশ যত কমাতে পারবে, তার ‘চোখ মারা’ তত সুনিপুন হবে। এতটাই মজার মানুষ সেই আপু। উনার ছেলে এখন ভার্সিটি পাশ করে চাকরী করছে। যাই হোক, বার্গার খাওয়ার সময়ের প্রসঙ্গে ফেরত আসি। আপু বললেন, বার্গার খাওয়ার সময় মেয়েদের অনেক বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। এক হল, মুখ বেশী করে খোলা যাবে না অর্থাৎ বড় করে ‘হা’ করা যাবে না। এতে নাকি প্রেস্টিজ চলে যাবে। কাজেই ঠোঁট মুখ চেপে চেপে অল্প অল্প করে বার্গার খেতে হবে। আর দ্বিতীয় শর্ত হল, খেতে গিয়ে বা ‘হা’ করতে গিয়ে কোন অবস্থাতেই ঠোটের লিপস্টিক নষ্ট করা চলবে না। বার্গারের বান বা রুটিটার সাথে কিছুতেই লিপস্টিক লাগতে পারবে না। এই দুই শর্ত মেনে খেতে গিয়েই মেয়েরা অনেক সময় নিয়ে ফেলে! আর ছোট ছোট কামড় দিয়ে যেন খেতে পারে সেজন্য বার্গার মাঝখান থেকে কেটে দেয়। এটা বলে আমার সেই আপা হাসতে লাগলো! উনি শুধু একটা কথা এড়িয়ে গেলেন, সেটা হল যত দেরী করে খাওয়া যায় তত বেশী প্রেম করা যায়! হয়ত উনি মনে করেছিলেন আমি ছোট, মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ি এসব কথা বলা কি উচিত হবে? আমি কিন্তু আমার সেই আপার না বলা কথা, কেন বার্গার খেতে অনেক সময় লাগে, সেটা ঠিকই বুঝে নিয়েছিলাম।    

View shawon1982's Full Portfolio