২২ জানুয়ারী ২০২০

হাতঘড়ি বা Wrist-Watch পরতে আমার বরাবরই ভাল লাগে কিন্তু খুব বেশী যে শখের কিছু বা অপরিহার্য কিছু যে মনে করেছি জীবনে তাও কিন্তু না। খুব বেশী শখের হলে তো বেশ কয়টা কিনে ফেলতাম! আমার কাছে হাতঘড়ি থাকে সবসময়ই একটা করে! আমি আমার এই জীবনে একটা হাতঘড়িও কিন্তু নিজে কিনি নাই কখনও! সবসময়ই কেউ না কেউ কিনে দিয়েছে। আমার জীবনে হাতঘড়ি প্রাপ্তি শুরু হয়েছে আমার আব্বুকে দিয়ে। যখন সৌদি-আরবে গিয়েছিলাম ১৯৮৮ সালে তখন থেকে। আব্বু আমার জীবনের শুরুতেই সেই ৬ বছর বয়সে প্রথমে আমাকে যে হাতঘড়িটা কিনে দিয়েছি সেটা হল Casio Game Watch । নাম শুনেই নিশ্চই বুঝে গেছেন, এই জাতীয় ঘড়িতে একটা গেম থাকতো। ইচ্ছে হলে বাটন টিপে টিপে গেম খেলা যেত। জাপানের আবিষ্কার সেই ১৯৮০র দশকে। তখন এটা ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। এই ঘড়ি আমার আর আমার খালাতো ভাইয়ের ছিল। আমরা ছিলাম একই বয়সী।

 

আমার গেমটা ছিল আপেল কুড়ানো! ঘরের ভেতর থেকে কিম্ভুতদর্শন একটা জীব(!) মাথায় ঝুড়ি করে বের হয়ে এসে শেষ মাথায় একটা আপেল গাছকে ধাক্কা দিত আর উপর থেকে আপেল খসে খসে পড়তো। আবার সরে এসে আপেল গুলা ঝুড়িতে নিয়ে ঘরে ফেরত যেতে হবে, তাহলে পয়েন্ট জমবে! গাছের উপর থেকে আবার কাঁটা জাতীয় কি যেন পড়তো! ওগুলা ঝুড়ির উপরে পড়লে মরে যেতে হবে! অথবা আপেল ঝুড়িতে ধরতে দেরী হলেও মরে যেতে হবে! চিন্তা করে দেখেন ব্যাপারটা একটু! আপনি আপেল ধরতে পারলেন না দেখে মরে যেতে হচ্ছে! কি আপেল আর কি আপনার জীবন! নির্দিষ্ট সময় পর পর আপেল পড়ার গতি বেড়ে যেত! তখন দ্রুত গিয়ে গিয়ে আপেল নিতে হবে। আমার খালাতো ভাইয়ের টা ছিল সম্ভবত রোবটের! উপরের থেকে মাথা পড়বে, সেগুলা রোবটের গায়ে লাগাতে হবে! মনে হয় এই ধরণেরই কিছু ছিল। বড় খালার বাসায় গেলে আমি আর আমার খালাতো ভাই ঘড়ি অদল বদল করে খেলতাম! ও আপেল কুড়াতো আর আমি কাঁটা ধড়ে মুন্ডু লাগাতাম!

 

আমার এই গেমের ঘড়িটা আমার কাছে ১৯৯৩ সালে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ছিল। ছোট বেলায় যত্ন তেমন বুঝতাম না। আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যায়। অনেক খেলসি ঘড়িটা দিয়ে। যে দেখতো তার কাছেই ভীষণ আকর্ষনীয় মনে হত। স্কুলে গেলে বন্ধুরাও কেউ কেউ আমার হাত থেকে ঘড়িটা খুলে নিয়ে খেলতো। যখন খেলতাম না, তখন স্কোর বোর্ডে সময় দেখা যেত আর ডেমো হিসেবে একা একা খেলাটা চলতেই থাকতো, চলতেই থাকতো! কত শতবার এই খেলা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেছি। আমাদের শৈশবে এইসব খেলাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাকের সময় তো আর কম্পিউটার বা ইউটিউব ছিল না!

 

এখন আমার চার মাসের ছোট ছেলেটাও আমার কোলে বসে বসে ভিডিও দেখে আর হাতপা ছুঁড়ে ছুঁড়ে নিজস্ব ভাষায় কোরাস দিতে থাকে! ক্লাস সিক্স বা সেভেনে আমার যতটুকু মনে পড়ে ঘড়ি পরতাম না। পরীক্ষার সময় দরকার হলে আব্বুর ঘড়িটা নিয়ে পরতাম। ক্লাস সেভেনে আমার জীবনে আরেকটা যুগান্তকারী ঘড়ি এল! সেটা আমার কাছে ছিল ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত একটানা! সেটাও Casio এর G-Shock এর বেশ হোমড়া চোমড়া একটা ঘড়ি। এটা পেয়েছিলাম আব্বুর বন্ধু মোতাহার আঙ্কেলের কাছ থেকে। উনি জাপান থাকতেন। জাপান  থেকে সরাসরি নিয়ে এনে দিয়েছিলেন। ভীষণ পছন্দের ঘড়ি ছিল আমার। আমার মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৭ টা সেমিস্টারের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি এই ঘড়ি পরে। ঘড়িটা ভীষণ মজবুত ছিল। আমার ভাল করেই মনে আছে, মতিঝিলে একবার কলেজে যাবার সময় এক ছিনতাইকারী আমার এই ঘড়িটার উপরে থাবা দিয়েছিল। কিছুই করতে পারেনি আহা বেচারা ছিনতাইকারী! শুধু এরপর থেকে আমি আরো সতর্ক হয়ে গেলাম। সবসময় বা-হাতের কব্জিতে ঘড়ি পরতাম, এরপর থেকে ঘড়ির হাতটা আর জানালার কাছে নিতাম না! ঘড়িটার উপরে একটা খুব মজবুত খোলসের মত ছিল। ভার্সিটিতে পড়ার সময় সেটা আলগোছে উঠে যায়। কিন্তু তারপরেও ঘড়িটার কিছুই হয়নি। বহাল তবিয়তেই পরেছি।

 

২০০৭ থেকে ২০০৯ এই দুই বছর আর সিঙ্গাপুরের প্রবাস জীবনে মোটামুটি ঘড়ি শূন্যই থাকলাম। মোবাইল ফোন দিয়েই কাজ সেরে নিতাম। ২০০৯ এ আমার বিয়ে যখন হল, তখন একটা দামী ঘড়ি উপহার পেলাম আমার বিয়ের ঘটক, আমার মামাতো ভগ্নিপতির কাছ থেকে। আমার স্ত্রী তারই আপন ভাগ্নি! কি প্যাঁচ খেয়ে গেলেন? একটু প্যাচালো ত বটেই। আমার মামাতো ভগ্নিপতি হচ্ছে আমার স্ত্রীর আপন মামা। এবার আপনারা বাকিটুক বুঝে নিয়েন! উনি আমাকে টাইটান এর একটা দামী ঘড়ি হাতে পরিয়ে দিলেন। সেটা এখনও আছে। একটু কম পরা হয়েছে। কিন্তু পরি! এরপরে ২০০৯ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মোটামুটি মোবাইল ফোন দিয়েই কাজ চালিয়ে নিচ্ছিলাম। ঘড়ি পরতাম না তেমন। ২০১৬ এর জন্মদিনে আমার স্ত্রী আমাকে সারপ্রাইজ(!) দেয়ার নাম করে, বনানী নিয়ে গেল এবং টাইটানের একজোড়া কাপল ওয়াচ কিনলো! টাকাটা দিতে হল আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেই। অবশ্য ও আমাকে দিয়ে দিয়েছিল টাকাটা! সেই কাপল ওয়াচের দুইটা আমরা দুইজন হাতে পরে বাড়ি চলে এলাম। ওরটা হারিয়ে গেছে বা চুরি হয়ে গেছে আরো বছর দুই আগেই। কিন্তু আমার ঘড়িটা সেই ২০১৬ এর জুনমাস থেকে বহাল তবিয়তে আমার সাথে সাথে বিপত্নীকের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। নীরবে সময় বলে বলে আমাকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে। ঘড়িটার কোন দাবী দাওয়া নেই। আজ প্রায় সাড়ে তিন বছর হয়ে গেল, একবারও সেটার ব্যাটারী পাল্টানোর দরকার হয়নি। আমি ভালই আছি আমার বিপত্নীক ঘড়িটা নিয়ে। কোঁথাও বের হলে ঘড়িটা হাতে না পরলে আমার খুব খালি খালি লাগে।   

View shawon1982's Full Portfolio