৮ জানুয়ারী ২০২০

তিন কালের কথা তো আমরা শুনেছি এবং পড়েছিও। অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। অতীত নিয়ে আমাদের কত ভয় আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কত দুশ্চিন্তা। আমার সাথে আপনারা একমত হবেন কিনা সেটা আমি জানি না, কিন্তু একটু মন দিয়ে চিন্তা করে দেখুন, ভালও করে ভেবে বলুন তো, বর্তমান আসলে কি? বর্তমান বলে কি আসলেই কিছু আছে? ঘড়ির কাঁটার দিকে একটু তাকিয়ে থাকুন। একটা দাগকে চিহ্নিত করুণ। সেকেন্ডের কাঁটা আসতে দিন। যে দাগ আপনি চিহ্নিত করেছেন, সেটা যদি বর্তমান হয়, তাহলে এখনও কাঁটা এসে পৌঁছায়নি এটা আপনার ভবিষ্যৎ। আর কাঁটাটা দাগ পার হয়ে যাওয়া মাত্রই হয়ে গেল তা অতীত তাই না? মাত্র দুই মিনিট আগেও আপনি যা করেছেন সেটা কি আপনার অতীত হয়ে গেল না? ভবিষ্যৎ আসছে। আমাদের ছুঁয়ে সাথে সাথে তা অতীত হয়ে গেল। তাহলে বর্তমান কোথায়? বর্তমান কে না ধরে রাখা যায় আর না সেটার কোন অস্তিত্ব আছে? এজন্যই তো বলি, আমার কোন বর্তমান নেই। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত আর অতীত অলঙ্ঘনীয়। হাজারবার মনকে প্রবোধ দিয়েছি, অতীত অমোচনীয়, অলঙ্ঘনীয়, তার পরেও কেন সেটা মনকে তাড়িত করে বেড়ায়? কে বেশী শক্তিশালী? অতীত না ভবিষ্যৎ?

 

আমার বর্তমান কি সেটা আমি জানি না। কি যেন একটা ভাবনা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে আজ কয়দিন ধরে। ধরতেও পারছি না। নিজেকে অনেকবার বোঝাতে চেষ্টা করেছি, কি হয়েছে আমার, কিন্তু ধরতে পারলাম না। ছুটির দিনগুলোতে গল্পের বই, উপন্যাস পড়া আমার অনেক পছন্দের একটা কাজ। কিন্তু এবার ছুটিতে বলতে গেলে কিছুই পড়তে পারলাম না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোট একটা উপন্যাস ‘ব্যর্থ স্বাধীনতা’ পড়েছি শুধুমাত্র। শ্রুতি নাটক শুনতে পছন্দ করি অনেক, এবার সেটাও শুনতে পারছি না একটানা মনস্থির করে। লিখতে গেলেও কেমন যেন সব খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ আর অতীতের ক্রান্তিকালে আমার এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। ভাল লাগছে না কিছুই। কিছু না।

 

আমার নানু তার মৃত্যুর আগে প্রায় বছর দুই আগে থেকেই স্ট্রোক জনিত কারণে অনেকটাই চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলেন। আমাদের দেখলেও চিনতে অনেক সময় লেগে যেত উনার। যখন চিনতে পারতেন, কি খাব না খাব সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। যেহেতু চিন্তা চেতনা অনেকটাই লোপ পেয়ে গিয়েছিল, মাঝে মাঝে অসংলগ্ন কথা বলতেন। একদিন হাতে একটা শাড়ী পুটুলির মত করে বের হয়ে এলেন বারান্দায়। আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আসি আমি। আমরা সবাই হাহাকার করে উঠলাম, নানু কোথায় যাচ্ছ? কারণ ঠিকমত হাঁটাচলা করার মত সুস্থতা উনার ছিল না তখন। উনি হাসিমুখে বললেন, ‘বাড়ি যাচ্ছি’! আমার মামী জানালেন, মা প্রায়ই বাড়ী যাওয়ার কথা হলে হাটা ধরেন। উনাকে অনেক বোঝায়ে শোনায়ে কয়েক কদম হাঁটিয়ে উনার ঘরে ফেরত নিয়ে আসা হত। উনি কি বুঝতেন জানি না, চুপ হয়ে যেতেন। আমাদের দেখতেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও ‘বাড়ি যাব’ এই ভাবনা উনাকে তাড়িয়ে বেড়াত। জানি না, উনার স্মৃতিশক্তি কি উনার ছোটবেলায় ফিরে যেত কিনা! ছোটবেলার সেই অনুভুতি থেকে বাবা মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করতো কিনা কিংবা তাদের দেখতে ইচ্ছে করতো কিনা। সেগুলা কখনো আমরা জানতে পারি নি।

 

আমি আমার প্রবাস জীবনে, বহুবার বহুবার বহুবার উপলব্ধি করেছি আমার নানুর বলা এই ‘বাড়ি যাব’ কি জিনিস। নিজেকে যখন খুব অসহায় লাগত, কাউকে যখন বলতে পারতাম না নিজের বুক ফাঁটা আর্তনাদ গুলো, তখন মনের ভেতর থেকে গুমরে ওঠা যে কষ্ট সেটাই ‘বাড়ি যাব’ অনুভুতি হয়ে কলিজা চিরে বের হত। মনে হত, আমার সব কষ্টের সমাধান এই ‘বাড়ি যাব’ এর মধ্যে রয়ে গেছে। আমার নানুর কন্ঠস্বর থেমে গেছে সেই ২০১২ সালেই। উনি উনার কাঙ্খিত বাড়ি যেতে পেরেছেন কিনা আমি জানি না। কিন্তু অতীত ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমিও বারবার বলে চলেছি, ‘বাড়ি যাব’। আমারো যে খুব বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে।  

View shawon1982's Full Portfolio