১৬ ডিসেম্বর ২০১৯

পরিবর্তনশীলতা যে কোন বস্তুরই স্বাভাবিক পরিণতি। যে কোন বস্তুই সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে। মানুষ তো বটেই। সময়ের সাথে সাথে আমাদের বয়স যেমন বাড়তে থাকে তেমনি বাড়তে থাকে অভিজ্ঞতা। আর অভিজ্ঞতার সাথে সাথে মানুষ চেষ্টা করে তাঁর আকাঙ্খিত উপায় খুঁজে বের করতে। নদীর পানিকে যেমন আটকে রাখা যায় না, তেমনি আটকে রাখা যায় না মানুষের পরিবর্তনশীলতাকেও। এটা যারা মেনে নিতে পারে, তাদের জন্য এটা কল্যান বয়ে আনে। সহজ স্বাভাবিক ভাবে এই পরিবর্তন মেনে নিতে না পারলে সেটা জীবনে দুঃসহ হয়েই আসতে পারে। ঘটাতে পারে অনেক সুসম্পর্কের ইতি। আমিও তো এর ব্যতিক্রম নই। হয়তো কারো চেয়ে বেশী আর একটু ভিন্নতর। কিন্তু আমিও পরিবর্তিত হয়েছি। আচরনে, ব্যবহারে, অভিজ্ঞতায় সবদিকেই। কেউ যদি আমাকে ধরে বসে থাকে যে আমি এখনও স্কুল পড়ুয়া বালকের মত অনেকটাই সুবোধ হয়ে থাকবো, তাহলে সে ভুলের স্বর্গে বাস করছে। কেউ যদি মনে করে আমার এই পরিবর্তনের জন্য আমি আর আগের মত নত নই কিংবা আমি অনেক ঔদ্ধত্ব প্রকাশ করছি, সেটা যে আমাকে দেখছে তাঁর দেখার ভুল হতে পারে। আমি মূলত আমার মতই আছি। শুধু নানা অভিজ্ঞতার আলোকে একটু ভিন্ন মোড়কে। কারণ সমাজে টিকে থাকতে হলে পরিবর্তনশীলতা অপরিহার্য হয়ে যায়।

 

যখন স্কুলে পড়তাম, তখন চেষ্টা করেও আমাকে আমার যাতায়াত খরচের চেয়ে একটাকাও বেশী কেউ দিতে পারতো না। ঠিক গুনে গুনে সেই কয় টাকাই নিতাম যা আমার লাগবে। যখন থেকে একা একা যাতায়াত শুরু করেছি ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে, তখন থেকে আব্বু অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার প্যান্টের কোমরের গোপন পকেটে ২০টাকা অতিরিক্ত রাখতে বললেন। আমি রাখতাম। সেটা সেরকমই পড়ে থাকতো। ওটাকে আমি বলতাম গোপন টাকা। বাসা থেকে যদি আমাকে কিছু কিনতে দোকানে পাঠানো হত তখন আমি বাজার করে এসে পাই পয়সার হিসাব বুঝিয়ে দিতাম। পঁচিশ পয়সা বা চার-আনা যাকে বলতো, সেটাও আমি নিজের কাছে রাখতাম না। আমার চাহিদা খুবই সীমিত ছিল।

 

আমার স্পষ্ট মনে আছে, একবার ঈদের আগে আব্বু আমাকে বলেছিল, ঈদে কি নিবা? আমি বলেছিলাম, আমাকে একটা আয়না কিনে দিও। আব্বু শুনে অবাক হয়ে বলেছিল, আর কিছু না? আমি বলেছিলাম না আর কিছু না। আমাকে আয়না কিনে দিয়েছিল। সেই আয়না দিয়ে আমি আলোর প্রতিফলনের খেলা খেলতাম। এটাই ছিল আমার ঈদ শপিং। আমাকে অনেকটা জোর করেই জামা জুতা কিনে দেয়া হত। এগুলার প্রতি আমার আগ্রহ তেমন ছিল না। যখন সেভেন এইটে পড়ি, তখন জুতা কেনার প্রসঙ্গ আসলে আব্বুকে বলতাম, তোমার পায়ের মাপে যা খুশি একটা কিনে নিয়ে এসো! আমার কোন চয়েস ছিল না। অনেক শখ করেই আমি প্রথম জিন্সের প্যান্ট কিনেছিলাম ১৯৯৭ সালের অক্টবর মাসে। ক্লাস নাইনে পড়ি তখন। তাও এক মামাতো বোনের বিয়েতে একটু ড্যাসিং(!) লুক নিব বলে জিন্সের প্যান্টটা কিনেছিলাম।

 

অতি উচ্চাকাঙ্খা বা উচ্চাভিলাষ আমার কখনই ছিল না। এখনও নেই। জীবনে নানা চড়াই উতরাই দেখতে হয়েছে। আমিও কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেছি। আগে যেগুলোতে নিতান্তই কাতর হয়ে পড়তাম বা ভেঙ্গে পড়তাম, এখন সেটা হয় না। এখন মন থেকে কিছুটা শক্ত হয়ে গেছি। হাতে টাকা পয়সা থাকুক বা না থাকুক, কিছুতেই যেন আমার কিছু যায় আসে না। নিজের মনকে এমন ভাবে গুছিয়ে রেখেছি, না খেয়ে মরে যাব সেও আমার জন্য ভাল তবুও কারো কাছে হাত পাতবো না, একমাত্র সৃস্টিকর্তা ছাড়া। কারণ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বার বার জেনেছি, অনেকটা নিষ্ঠুরভাবেই জেনেছি যে, নিজের হাতে টাকা না থাকলে প্রতিপদে অবজ্ঞার স্বীকার হতে হয়। কারণ মানুষ অতীত মনে রাখে না যে! আর যদি আমার হাতে টাকা থাকে, তখন অন্য যার কাছেই টাকা চাইবো, আরো যদি লাগে, সমস্যা নেই। যত চাইবো পাবো। কিন্তু বিপদে পড়ে মানুষের কাছে টাকা চাওয়ার চেয়ে বড় অপমান একটা মানুষের আর কোন কিছুতেই হতে পারে না। টাকা পয়সার কারণে কারো কাছে মাথা নত করার চেয়ে, মরে যাওয়া আমার জন্য অনেক সহজ। টাকার জন্য কিছু একটা আটকে আছে, থাকুক, লাগবে না। বেশীর বেশী কি হবে? পাব না? দরকার নেই। তবুও অন্যের কাছে টাকার জন্য মাথা নোয়াতে পারবো না। স্বাধীনভাবে থাকতে চাই। এতে যদি কেউ মনে করে আমি পরিবর্তন হয়ে গেছি? তো গেছিই। এই ভাল আমার জন্য।

 

২০১৪ সালের কথা। তখন আমি বেকার। জ্বী! উল্লেখযোগ্য কোন চাকরী কিছুই ছিল না। হাত শুন্য ছিল একসময়। একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতাম। ফিজিক্স পড়াতাম। ক্লাস ভিত্তিক টাকা। প্রত্যেকে ক্লাসের জন্য ৮০টাকা করে পেতাম। পরে সেটা বেড়ে ১০০টাকা হয়েছিল! সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো সেই কোচিং সেন্টারের উপর। ওখান থেকেই আমি পেয়েছিলাম আমার শিক্ষক হবার হাতেখড়ি। আমার জীবনের প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষকতা। ওখানে থেকে আমি অনেক ভাল ভাল কিছু ছাত্র পেয়েছি যাদের সাথে আজও আমার সুসম্পর্ক অটুট আছে। যা হোক, যা বলছিলাম! তখন প্রচন্ড গরমের সময়। আমার স্ত্রী তখন ৬ মাসের গর্ভবতী। পেটে আমাদের মেয়েটা। ও তখন আমার শশুরবাড়ীতে ছিল। ওকে দেখতে যাইতাম। রিক্সাভাড়া বেশীর বেশী ২০ টাকা ছিল আমাদের বাসা থেকে। আমি হেঁটে যেতাম। এমন সময় গেছে যখন ঐ বিশটা টাকাও আমার কাছে মূল্যবান ছিল। একদিন হেঁটে যাচ্ছিলাম রাস্তা দিয়ে। পথে শশুরবাড়ীর এক আত্মীয়র সাথে দেখা। বললেন, কোথায় যাও? আমি জানালাম। বললেন, হেঁটে যাচ্ছ কেন এই গরমের মধ্যে? প্রেসার বেড়ে যাবে তো! আমি বললাম, এমনি, একটু হাটাহাটি করলাম আরকি! অল্প রাস্তাই তো! একথা বলে হেসে আমি সামনে যাওয়া শুরু করলাম।

 

এখন আমার সেই মেয়েটার বায়না মেটাতে শশুরবাড়ী যাওয়ার সময়, UBER থেকে গাড়ি ডেকে নেই। এসির প্রভাবে সারা গাড়ী ঠান্ডা হয়ে থাকে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেয়ের সেই নানাবাড়ীতেই চলে আসি, যেদিন একসময় আমি মানুষের চোখ লুকিয়ে হেঁটে আসতাম। এসির ঠান্ডা বাতাসের ভেতর আমার যে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে সেটা উত্তপ্তই থাকে। ঠিক আগের মতই। শুধু আমি মানুষটা আগের থেকে পরিবর্তন হয়ে গেছি।

View shawon1982's Full Portfolio