৫ নভেম্বর ২০১৯

প্রতিদিন পাবলিক বাসের চড়ার সুবাদে নানা ধরণের মানুষের কর্মকান্ড চোখে পড়ে। সবকিছু বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কলেজ ভার্সিটি থেকে শুরু করে চাকুরীজীবী নানা ধরনের মানুষের সমাবেশ থাকে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট গুলাতে। নানা ধরনের কথা, নানা ধরণের আচরণ। খুব অবাক লাগে যখন দেখি সুন্দর সুন্দর পোষাক পরা লোকগুলো কি অবলীলায় বাসের ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরের সাথে তুই তোকারি করছে! বাস কোথাও একটু দাঁড়ালেই কি অবলীলায় তারা অশ্রাব্য গালিগালাজ করছে। ভাড়া নিয়ে প্রতিনিয়ত বাসের কন্ডাক্টরের সাথে বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হচ্ছে। আমি বলছিনা যে বাস ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টর সবসময় খুব ভালও কিছু করবেই। অনেক সময় চরম ব্যস্ততার মুহুর্তে যখন অযাচিত দেরী করে বা বাস থামিয়ে রাখে তখন খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেজন্য একজন শিক্ষিত মানুষ প্রকাশ্যে অশ্রাব্য গালিগালাজ করবে কেন? এক্ষেত্রে আমি একটা জিনিস দেখেছি। ভার্সিটির ছাত্রদের সাথে ভাড়া নিয়ে তর্ক হয় ওদের সাথে, কিন্তু ভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীদের মুখে আমি নোংরা শব্দের গালি শুনেছি বলে মনে পড়ে না। কারণ আমার মনে হয় ওদের যেহেতু শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ততা আছে, তাই ওদের মুখে গালি আটকে যায়। আর যারা শিক্ষা থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছেন, তাদের মুখে খুব একটা গালি আটকায় না। তারা ভুলে যায় কখনও তারাও হয়ত কিছু লেখাপড়া করেছে। শিক্ষা আর সুশিক্ষার মধ্যে মনে হয় এটাই পার্থক্য। একজন শিক্ষিত মানুষের ধর্মই হল সে অন্যকে তার ন্যায্য সন্মান দিয়ে কথা বলবে। কারণ অন্যকে সন্মান না দিলে নিজে সন্মানিত হওয়া যায় না। যে অন্যকে সন্মান দিতে জানে না বা বা অন্যের মতামত মানতে পারে না, সবসময় নিজেকেই ঠিক মনে করে; তাকে আর যাই হোক, আমার সুশিক্ষিত মনে হয় না। এদের সুশিক্ষার চেয়ে কুশিক্ষার প্রাবল্যই বেশী।

 

গতবছরের একটা কথা মনে পড়ে গেল। বাসে উঠেছি। বাস প্রায় মাঝ রাস্তায় চলে এসেছে। আমার অভ্যাস হল, কন্ডাকটর ভাড়া চাইবার আগেই ভাড়া হাতে বের করে রাখি। নটরডেম কলেজে ১৯৯৯ সালে যখন ভর্তি হই তখন প্রিন্সিপ্যাল ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা’র মুখে এমনটাই শুনেছিলাম। ফাদারের সেই কথা আমার মনে বসে আছে, ‘ভাড়া চাইবার আগেই তুমি ভাড়া দিয়ে দিবে’। কিন্তু মানিব্যাগে হাত দিয়ে আমি ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাল। আমি খেয়াল করি নাই যে, যা ভাড়া তার চেয়ে কম প্রায় অর্ধেক টাকা আছে ওতে। আমার কাছে ঐ মুহুর্তে আর কোন টাকা নেই। লজ্জায় পড়ে গেলাম। কিছুই যে করার নাই তখন। কন্ডাক্টর আমার কাছাকাছি যখন চলে এল, আমি হাতের ইশারায় ডাকলাম ওকে। কাছে এলে আমি আবার ইশারা করলাম। ছেলেটা আমার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে দিল। বুঝতে পারলো আমার লজ্জা বা গোপনীয়তা। আমি ওর কানে কানে বললাম। ও শুনে সাথে সাথে হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকে থামিয়ে দিল। বুঝালো আপনাকে কিছুই বলতে হবে না; আর কোন ভাড়াও দিতে হবে না। আমি মানিব্যাগে যা ছিল তাই ওর হাতে গুজে দিলাম, বললাম এটা আছে, এটাই নাও ভাই। ও সেটাই নিয়ে পাশের সীটে চলে গেল। ঘটনা এইটুকুই! প্রতিনিয়ত যাদের গালি দিয়ে আমরা জর্জরিত করে ফেলি, সেই ছেলেটাই ইচ্ছা করলে আমাকে উচ্চবাচ্য করতে পারতো। দুইটা কথা শুনাতে পারতো। না হয় এইটুক তো বলতেই পারতো, ভাড়া নাই উঠছেন কেন? তাহলে? আমার সেই কথা শোনা ছাড়া কোন উপায় থাকতো কি? ছেলেটা বলেনি। কারণ সে বুঝেছিল আমার ওই মুহুর্তের দৈন্যতা। মানবিকতার আড়াল দিয়ে ছেলেটা আমার লজ্জাকে অন্যের সামনে ঢেকে দিয়েছে। অফিস এসে গেল। নেমে পড়লাম। কন্ডাক্টর ছেলেটা গেটের মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ওর দিয়ে তাকিয়ে বললাম, ধন্যবাদ ভাই। ছেলেটা মুচকি হেসে বাসের সাথে চলে গেল। ছেলেটা কতটুকু লেখাপড়া করেছে সেটা আমি জানি না। কিন্তু ছেলেটাকে সেদিন আমার সুশিক্ষিত মনে হয়েছে। কারন একজন বিপদে পড়া মানুষকে সে সন্মান দেখিয়েছে।

 

View shawon1982's Full Portfolio