বন্ধ্যা তিমির

একগাদা জিনিস নিয়ে ঘরে ঢুকলো রায়হান। ইপ্সিতা’র জন্য জামদানী শাড়ি, স্যান্ডেল, আড়ং এর লেদার ব্যাগ, দীপ্ত’র জন্য এক সেট জামা, প্যান্ট, খেলনা, চকলেট, ঘড়ি আরো কতো কি! এতকিছু একসাথে এনেছে দেখে ইপ্সিতার চোখ কপালে উঠে গেল।

 

তুমি করেছো কি? এত কিছু কিনতে গেলে কেন? বিস্ময়ের সাথে বলে।

কেন এ আর এমন কি? তোমাদের জন্য কিছু কিনতে মন চাইলো তাই আনলাম। হাসি হাসি মুখ করে ইপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বলে রায়হান।

জিনিসগুলো নিয়ে গোছাতে শুরু করে ইপ্সিতা। রায়হান খাটের উপরে শুয়ে পড়ে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে।

একি! শুয়ে পড়লে যে? হাতমুখ ধুয়ে আসো! খাবার দেই। কত বেলা হল।

নাহ, এখন খাবো না। দীপ্ত কই?

ও ঘুমাচ্ছে স্কুল থেকে এসে। তুমি খাবে না কেন? কিছু কি খেয়ে এসেছ নাকি?

না খাই নি। এইজন্যই তো খাব না। তোমাদের নিয়ে বাইরে খেতে যাব।

তুমি যে কি না! এতগুলো টাকা খরচ করে এত কিছু কিনতে আবার বাইরে খেতে যাবে? কি দরকার?

শাড়িটা তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা বললে না তো? বলেই ইপ্সিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রায়হান।

আহ! কি করছো? দীপ্ত দেখে ফেলবে তো! লজ্জা পায় ইপ্সিতা।

পছন্দ হয়েছে?

হুম! খুব সুন্দর হয়েছে!

তাহলে রেডী হও। আজকের কেনা শাড়ীটাই পর। তোমাকে খুব সুন্দর মানাবে। তোমার পছন্দের আকাশী কালার বেছেই আনলাম। আমি গোসল করে আসি। তুমি রেডী হও। দীপ্তকেও ডাক দাও। ওর জিনিসগুলো দেখুক। সারপ্রাইজড হোক।

তা তো হবেই। তুমি যাও তো! ফ্রেশ হও। তাড়া লাগায় ইপ্সিতা। রায়হানের হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দেয়। রায়হান বাথরুকে ঢুকেই শিষ বাজাতে শুরু করে।

 

দীপ্ত! কি খাবে বলতো বাবা? পিজ্জা নাকি চাইনিজ? রায়হান ছেলের গাল টিপে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে। দীপ্তর বয়স দশ শেষ হয়ে এগারতে পড়লো। ধানমন্ডিতে একটি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে।

চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যাব বাবা।

ঠিক আছে তাই হোক। রায়হান আবার শিষ বাজাতে শুরু করে। নিজেই গাড়ী ড্রাইভ করছে। ইপ্সিতা পাশের সিটে বসে একটা ম্যাগাজিন উল্টাচ্ছে।

 

চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকেই দীপ্ত দৌড় দিয়ে একটা টেবিল খালি দেখে বসে পড়লো। হাত নেড়ে বাবা মা কে ডাকলো। রায়হান বলল, চল ওখানেই বসি ইপ্সিতা। বেশ নিরিবিলি আছে। এইদিকটায় অনেক ভিড়।

 

আমার সেটা মনে হয় না। ওখান থেকে মাছের একুরিয়ামটা ভালো করে দেখা যায়। আজ বেশ কয়েকদিন থেকেই দীপ্ত একুরিয়ামের জন্য বায়না করছে। ইপ্সিতা টেবিলের দিকে যেতে যেতে বললো।

হুম দিব তো কিনে ওকে একুরিয়াম। ওর জন্মদিন তো সামনের মাসেই। ওর এই বার্থডেতেই ওকে একুরিয়াম কিনে দেব। আমার প্ল্যানে আছে। ওকে কিছু বলার দরকার নেই।

কি দরবার বলতো? ইপ্সিতা বলে ওঠে। ওর আগ্রহ দুই দিনেই শেষ হয়ে যায়। আজ এই বায়না তো কাল ঐ বায়না। বাদ দাও তো।

আরে ধুর কি বল! এই বয়সে বায়না ধরবে না তো কি আমার মত বয়সে বায়না করবে? রায়হান একগাল হেসে বলে।

 

তোমার কাহিনী কি বল তো? আজ বলা নেই কওয়া নেই হঠাত খাওয়াতে নিয়ে চলে এলে? ইপ্সিতা প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে তাকায় রায়হানের দিকে। দীপ্তর কোন দিকেই নজর নেই। একমনে একুরিয়ামের মাছের কান্ড দেখছে।

কেন মাঝে মাঝে তো আমরা বাইরে খেতে বের হই। সমস্যা কি?

না কোন সমস্যা নেই।

বেয়ারা এল মেনু নিয়ে। ইপ্সিতা আর দীপ্তর পছন্দ অনুযায়ী খাবারের অর্ডার করা হল।

 

খাবার খাওয়া শেষ হতেই দীপ্ত বলে, বাবা আমি একুরিয়ামটা কাছ থেকে দেখে আসি? প্লিজ?

মুখের পুরে দেয়া মাংসের টুকরাটা গিলে রায়হান বললো অবশ্যই যাও। দীপ্ত মায়ের অনুমতির ধার ধারলো না। চলে গেলো একুরিয়ামের কাছে।

ইপ্সিতার খাওয়াও শেষ। কোল্ড ড্রিংস খাচ্ছিলো। রায়হান বললো, ইপ্সিতা!

বল।

তোমার সাথে জরুরী কথা ছিল।

বলই না। এত ভূমিকা দেয়ার কি আছে?

বলছি। আমি ডাক্তারের কাছ থেকে রিপোর্ট নিয়েছি।

কি বলেছে ডাক্তার? ইপ্সিতার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে।

দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তুমি ঠিক আছ। ডাক্তার বলেছে তোমার কোন সমস্যা নেই। রায়হান আস্বস্ত করার সুরে বলে। গলাটা মনে হল শেষদিকে কেমন ভারী শোনালো।

প্লিজ পুরা কথা বল। এই আধাআধি কথা শুনতে ভাল লাগছে না। ইপ্সিতা ব্যস্ত হয়ে বলে।

টেনশন করো না। বলছি। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন মায়র সাথে নানা বাড়িতে যাবার সময় আমাদের গাড়ী এক্সিডেন্ট করে বলেছিলাম না তোমাকে?

হুম বলেছিলে। তোমার কপালে কাটা ডাগটাতো ওখানে থেকেই তাই না?

হ্যাঁ। ঠিক বলেছ। ওই অ্যাক্সিডেন্ট আমাকে শুধু কি কাটা দাগটাই না আরো কিছু দিয়ে গেছে। রায়হান সরাসরি ইপ্সিতার চোখের দিকে তাকায়। আবার বলতে শুরু করে। আমার তেমন কিছুই মনে নেই। যখন হুঁশ ফেরে তখন আমি নিজেকে হাসপাতালে দেখি। মা যে মারা গিয়েছিল সেটা আমি অনেকদিন পরে জানতে পারি।

তুমি বলেছিলে। ইপ্সিতা বলে ওঠে। মনে মনে তাড়া অনুভব করে। এইগুলা কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে রায়হানের মুখে শুনতে।

আমার আরো একটা স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যায় ইপ্সিতা। যেটা আমি জানতাম না। জানার কোন উপায় ছিল না।

কি বলছো এসব? ইপ্সিতার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে।

ঠিকই বলছি। আমি জানতাম না। ডাক্তার আমাকে বলেছে। ওই আক্সিডেন্ট এ আমি মারাত্মক আঘাত পাই। এরপর থেকে আমার স্পার্ম প্রোডাকশন অ্যাবিলিটি নষ্ট হয়ে যায়। এটা ঠিক হবার কোন উপায় নেই। এই কারণে আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন আমাদের সন্তান হবার কোন সম্ভাবনা নেই।

অনেক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। ইপ্সিতা মাথা নীচু করে বসে আছে। রায়হান খেয়াল করে দেখলো ইপ্সিতার দুইচোখ বেয়ে দরদর করে পানি নামছে।

 

দীপ্ত এসে রায়হানের গলা জড়িয়ে ধরলো। বায়না করে বললো, আব্বু আমাকে একটা একুরিয়াম কিনে দেবে? প্লিজ, প্লিজ আব্বু! সাজিদের কি সুন্দর একটা আছে। খেলনা না, সত্যিকারের একুরিয়াম। দেবে কিনে আব্বু?

দিপ্তকে নিজের কোলে টেনে নেয় রায়হান।

অবশ্যই দেব কিনে। আর কি কি চাই তোমার?

আর কিছু না। লাভ ইউ আব্বু বলেই দীপ্ত রায়হানের গালে চুমু দেয়।

রায়হানও ছেলের গালে চুমু দেয়। চল বাসায় যাই বাবা। ইপ্সিতা চল যাই।

ইপ্সিতা তখনও চোখের পানি মোছেনি। রায়হানের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখে মুছেই রায়হানের ডান হাত চেপে ধরে।

তুমি কি সব জানতে চাও?

না। সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে দীপ্তর হাত ধরে গেটের দিকে এগিয়ে যায় রায়হান।

Author's Notes/Comments: 

25th october 2016

View shawon1982's Full Portfolio