ব্যস্ত জীবন [Bangla Story]

মেহজাবিনের বিয়ে হয়েছে প্রায় এক মাস হল। তার স্বামী ফারদিন হাসান একজন ব্যবসায়ী। মেহজাবিন সবেমাত্র একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছে। তার স্বামী খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ায় মেহজাবিন নিজেকে বেশ ভাগ্যবতী মনে করে।

 

ফারদিন মেহজাবিনকে নিয়মিত পত্রিকা পড়তে বলে কারণ পত্রিকায় অনেক চাকরীর বিজ্ঞাপন আসে। মেহজাবিনের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ইয়াসমিন তার সাথেই পড়াশুনা শেষ করলেও দুর্ভাগ্যবশত সে কোনও চাকরীর জন্য আবেদন করতে পারছে না কারণ ইয়াসমিনের স্বামী এবং শ্বশুর-শাশুড়ি কেউই চায় না সে চাকরী করুক।

 

ইয়াসমিন যখনই মেহজাবিনের সাথে ফোনে কথা বলে, তখন দু চোখ বেয়ে অশ্রুর ঝরনাধারা বইতে থাকে। মেহজাবিন তখন বুঝে পায় না যে কিভাবে ইয়াসমিনকে সান্ত্বনা দেবে। একটি চালের বস্তা ছিদ্র হলে যেমন চাল পড়তে পড়তে স্তুপ হয়ে যায়, ঠিক তেমনই ইয়াসমিনের মনের ভেতর ধীরে ধীরে স্বামীর উপর রাগের পাহাড় গড়ে উঠতে থাকে।

 

যাইহোক, মেহজাবিন পুরোদমে চাকরীর জন্য বিভিন্ন জায়গায় নিজের জীবন বৃত্তান্ত পাঠাতে থাকে। ইতোমধ্যে দু এক জায়গায় চাকরীর সাক্ষাৎকার দিয়েছে। সে যোগ্যতায় অবশ্যই এগিয়ে আছে কিন্তু আজকাল চাকরী পেতে হলে যে জিনিসটা অপরিহার্য সেই মামার জোর নেই তার। মানে তার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে এমন কেউ নেই যাদের একটি মাত্র ফোনে তার চাকরী হবে। অবশ্য যদি এমন প্রভাবশালী কেউ থাকলেও মেহজাবিন কোনও সাহায্য বা অনুগ্রহের জন্য অনুরোধ করত না কখনই।

 

মেহজাবিনের ব্যক্তিত্ব পাথরের মত দৃঢ়। তার কথা হচ্ছে এই যে জীবনে কিছু করলে নিজের যোগ্যতায় করবে। এ ব্যাপারে ফারদিনের সাথে তার মনের অনেক মিল। ফারদিনের প্রায় সব কিছুই মেহজাবিনের ভালো লাগে। তার মায়াবী চোখ, চওড়া কাঁধ, ঘন কালো চুল, বুক ভর্তি কালো লোম ছাড়াও ব্যায়ামবীরদের মত তার সুঠাম দেহ যে কারো নজর কারতে বাধ্য। ফারদিনের যে জিনিসটা মেহজাবিনের সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে সেটা হচ্ছে তার শিশুর মত নিস্পাপ মন।

 

এত ভালো লাগার মধ্যে একটু আধটু খারাপ লাগা যে একেবারে নেই সেটা বললে ভুল হবে। ফারদিনের ব্যস্ততাকে মেহজাবিন খুব ঘৃণা করে। মানুষ রাস্তার পাশের স্তুপ করে রাখা ময়লা আবর্জনাকে যেমন ঘৃণা করে ঠিক তেমন। সে সকাল দশটায় বের হয়ে যায় আর ফিরতে ফিরতে কখনও রাত এগারোটা, কখনও বারোটা বেজে যায়। মেহজাবিন টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করতে করতেই কখনও কখনও ঘুমিয়ে পড়ে। ফারদিন যখন কলিং বেল চাপে, তখন তার ঘুম ভাঙ্গে।

 

ফারদিন দিন দিন এতই ব্যস্ততার জালে জড়িয়েছে যে মেহজাবিনের জন্মদিনও তার মনে থাকে না। এমন একটা বিশেষ দিনে মেহজাবিনের কত পরিকল্পনা থাকে কিন্তু ফারদিনের কাছ থেকে কোনও উপহার তো দূরে থাক, সামান্য “Happy birthday to you” শব্দগুলোও তার মুখ দিয়ে বের হয় না। মেহজাবিন যখন দুঃখী মন নিয়ে তার জন্মদিনের কথা বলে তাকে, তখন সে হাত জোর করে, কানে ধরে বাচ্চাদের মত ক্ষমা চেয়ে মেহজাবিনের মন ভালো করতে চেষ্টা করে।

 

কখনও কখনও মেহজাবিনের মনে ফারদিনের জন্য মায়ার জন্ম হয়। তার স্বামীটি সারাটা দিন ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকে। বাইরে কোথায় কি খাচ্ছে না খাচ্ছে, এত পরিশ্রম করছে তা তো পরিবারের জন্যই। কিন্তু যখন মেহজাবিন এর উল্টোটা ভাবে, তখন তার মনে হতাশার মেঘ এসে ভর করে। মানে তার মনে হয় যে এমন ব্যবসার কি কোনও মানে আছে যা নিজের স্ত্রীকে তার স্বামীর সান্নিধ্য থেকে তীর ছেড়ে যাওয়া নৌকার মত ধীরে ধীরে দূর থেকে আরও দূরে ঠেলে দেয়!

 

মেহজাবিন যথারীতি চাকরীর বিজ্ঞাপন দেখলে আবেদন করে। কিন্তু চাকরী নামক সোনার হরিণের দেখা এখনও পর্যন্ত সে পায়নি। মাঝে মাঝে তার মনে হয় যে যদি কোনও ব্যাংকে তার চাকরীটা হয়ে যায়, তখন তার ব্যস্ততা দেখলে হয়তো ফারদিন বুঝবে যে এত দিন কত একাকী সময় কাটিয়েছে মেহজাবিন।

 

ফারদিন যখন বাইরে থাকে, মেহজাবিনের সঙ্গী হচ্ছে টিভি এবং কম্পিউটার। মাঝে মাঝে যখন একটানা টিভি দেখে বিরক্তি আসে তখন সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ পড়ে। নষ্টনীড় গল্পটি তার মনে দাগ কেটেছে কারণ সেখানে স্ত্রী হিসেবে চারু তার স্বামী ভূপতির কাছ থেকে যে সঙ্গ আশা করে তা পায় না। এ যেন মেহজাবিনের বিবাহিত জীবনের হুবহু প্রতিফলন!

 

একদিন দুপুরবেলা ফারদিন মেহজাবিনকে ফোন দিয়ে রীতিমত চমকে দেয়। সে মেহজাবিনকে তৈরি থাকতে বলে কারণ তারা বাইরে কোনও একটা উন্নত মানের রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ করবে। একটি বাচ্চা স্কুলে গিয়ে নতুন বই হাতে নেবার পর যেমন আনন্দিত হয়, মেহজাবিনের আনন্দটাও তেমনি নিস্পাপ। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না! সে মনে মনে ভাবছে যে এটা কল্পনা নয় তো?

 

        বিয়ের এক বছর হতে চলল; এত দিন তো ফারদিনের মধ্যে এমন রোমান্টিকতা দেখা যায় নি! হয়তো সে আসলেই অনুভব করতে পেরেছে যে প্রতিদিন কতটা একাকীত্ব এবং বিষণ্ণতা মেহজাবিনের উপর ভর করে।

 

        মেহজাবিন ঝড়ের গতিতে তৈরি হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে। আজ সে একটা নীল শাড়ি পড়েছে। মেহজাবিন এমনিতেই খুব সুন্দর; নীল শাড়িতে তাকে অসাধারণ লাগে; যেন স্বর্গ হতে কোনও পরি পথ ভুলে এই ধরণীতে এসে পড়েছে! দুই ভ্রুর ঠিক মাঝখানে শোভা পাচ্ছে একটি নীল টিপ। ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। একহাতে ছয়টা চুড়ি পড়েছে; সবগুলো চুড়ির রং নীল। শাড়ির রঙের সাথে মিলিয়েই পড়া। বলাই বাহুল্য যে নীল রঙটা মেহজাবিনের অসম্ভব রকম প্রিয় কারণ তার বিশ্বাস যে নীল রঙটি খুবই বিশেষ ধরণের একটি রং। বিশাল আকাশের রং নীল; একইভাবে বিশাল সাগরের পানির রঙ্গও কিন্তু নীল। প্রকৃতিতেই যেহেতু এ রঙটির খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে, তাই মেহজাবিনের কাছেও এটিই তার প্রিয় এবং সৌভাগ্যের রং।

 

            একদিন মেহজাবিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরীর সাক্ষাৎকার দেয়ার পরপরই তার চাকরীটা হয়ে যায়। খুশীতে আত্মহারা হয়ে তার নাচতে ইচ্ছে হয়। একবার ভাবে যে ফোনে ফারদিনকে সুখবরটা দেবে; পরক্ষণেই চিন্তা করে যে বাসায় গিয়ে রাতে যখন স্বামী আসবে তখন তাকে এই সারপ্রাইজটা দেবে।

 

        মেহজাবিন রিক্সায় চড়েই বাসায় ফেরা অবস্থায় বাসার প্রায় কাছাকাছি আসতেই পেছন থেকে একটি ট্রাক এসে রিক্সাটিকে ধাক্কা মেরে মুহূর্তেই কোনও প্রেতাত্মার মত যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। রিক্সাওয়ালা সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। মেহজাবিনের দেহে প্রাণের স্পন্দন কিছুক্ষণের মত ছিল, তারপর সব অন্ধকার।

 

        ফারদিনের কানে এই দুঃসংবাদ পৌঁছতে না পৌঁছতেই সে বিদ্যুতের বেগে এসে উপস্থিত হয়। আজ তার কাছে কোনও ব্যস্ততাই যেন ব্যস্ততা নয়। মেহজাবিনকে জড়িয়ে ধরে সে সর্বহারা দরিদ্র পরিবারের কর্তার মত কেঁদেই চলেছে। আজ যেন সময় থমকে গেছে মেহজাবিনের কাঠের টুকরোর মত পড়ে থাকা নিথর, নিষ্প্রাণ দেহের আশেপাশে। এই প্রথমবার ফারদিন অনেকক্ষণ ধরে মেহজাবিনের বরফ শীতল হাতটি ধরে হাসপাতালের বেডের পাশে বসে আছে। ডাক্তাররা তাকে উদ্দেশ্য করে কি বলছে না বলছে তাতে তার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। ফারদিনের অগাধ বিশ্বাস মেহজাবিন চোখ মেলে তার দিকে তাকাবেই!

View kingofwords's Full Portfolio