মারাত্মক সমস্যা [Story]

       জামিলার তালাক হয়েছে প্রায় ছয় মাস হয়। সে অবশ্য খুব যে কষ্টে আছে তা নয়। তার চার বছরের ছেলে জায়েদকে নিয়ে ভালোই কেটে যাচ্ছে দিনকাল। কিন্তু তার মা রেহানা বানু তাকে আবার বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।  

 

        জামিলা যতবারই বিয়ের কথা শুনে, ততবারই চেহারায় এক মহা বিরক্তির ছাপ এনে অন্য রুমে গিয়ে বসে থাকে। তার এখন একটাই স্বপ্ন- ছেলেটাকে শিক্ষিত করে তোলা, তাকে মানুষ করা। সমাজে যাতে সে মাথা তুলে সম্মানের সাথে দাঁড়াতে পারে। তাকে যেন তার মায়ের মত দারিদ্র্য নামক অভিশাপ স্পর্শ না করে।  

 

        সৌভাগ্যবশত জামিলা একটি বুটিকের দোকানে কাজ পেয়ে যায়। যদিও বেতন খুবই নগণ্য, তবুও সে খুব খুশী এই ভেবে যে তাকে কারো কাছে হাত পাততে হবে না। সে নিজের এবং জায়েদের খরচ নিজেই সামলাতে পারবে। অন্যদের খোঁচায় তীরের মত বিদ্ধ হতে হবে না।

 

        ইতোমধ্যে রেহানা জামিলাকে আবারও বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছে। কয়েকজন ভালো পাত্র নাকি আছে। তাকে দেখতে চাইছে। জামিলা আহত সিংহীর মত হুঙ্কার দিয়ে বলে দিয়েছে যে এরপর কখনও যদি তাকে এ সম্পর্কে বলা হয় তবে সে হয় আত্মহত্যা করবে নতুবা জায়েদকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাবে।

 

        তারপর থেকে কেউ আর জামিলাকে বিয়ের কথা বলতে সাহস পায় না। জামিলার বাবা আজমল আখন্দ বেঁচে নেই। দু বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় নির্মমভাবে প্রাণ হারান। জামিলা তার বাবাকে খুব মিস করে। তার বিশ্বাস যে তিনি বেঁচে থাকলে তার কথার মূল্য নিশ্চয়ই থাকতো। কেউ অহেতুক জ্বালাতন করার সাহস পেত না।

 

        যাইহোক, জামিলা তার দক্ষতা, সততা এবং নিষ্ঠা দিয়ে অতি অল্প সময়ে দোকানে সবার মন জয় করে ফেলেছে। যতক্ষণ দোকানে থাকে ততক্ষণ জায়েদ তার দাদীর সাথেই সময় কাটায়। ছেলেটার জন্য তার মন খুব কাঁদে। প্রায় সারাদিন তাকে দেখতে পায়না, বুকে জড়িয়ে ধরতে পারে না, ইচ্ছেমত আদর করতে পারে না।

 

        জায়েদের কথা মনে হলে মনের অজান্তেই জামিলার চোখে পানি চলে আসে। যখন সে বাসায় ফিরে আসে তখন জায়েদ হয় ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করছে নতুবা দু চোখের পাতা ঘুমের ভারে ঢলঢল।

 

কষ্ট বিনা কেষ্ট মেলে না। জীবনে কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। জীবন এমনই। জামিলা তার অল্প বয়সেই জীবনের নিষ্ঠুর চেহারা দেখেছে। তবে সে হেরে যাওয়াদের দলে নয়। লৌহের মত দৃঢ় তার মনোবল। সে সবাইকে দেখিয়ে দেবে যে একা থেকেও জীবনে সাফল্য অর্জন করা যায়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়।

 

একদিন জামিলার ফোনে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে। সে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে জায়েদের বাবা বিল্লাল মিয়ার কণ্ঠ কানে ভেসে আসে। সে বেশ অবাক হয়। কারণ তালাক হবার পর অনেকদিন কেটে গেছে। তাকে ফোন করার কোনও যুক্তি সে খুঁজে পাচ্ছে না।

 

ফোন করার কারণ জানতে চাইতেই বিল্লাল বলে যে সে ভুল করেছে। জামিলা যাতে তাকে মন থেকে মাফ করে দেয়। জামিলা এসব কথার আগাগোড়া বুঝতে পারে না। তার কাছে এই মুহূর্তে সব কথাগুলো একেবারে অসংলগ্ন মনে হয়।

 

জামিলা রাগ করে ফোনের লাইন কেটে দেবে এমন সময় বিল্লাল তাকে আবারও একসাথে জীবন কাটানোর প্রস্তাব দেয়। জামিলা এমন প্রস্তাবে যেন আকাশ থেকে মাটিতে পড়েছে এমন অবস্থা। সে বলে যে এটা কখনও সম্ভব নয়। কিন্তু বিল্লাল নাছোড়বান্দা ছেলের মত বারবার একই কথা বলে যাচ্ছে। সে নাকি কার কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে হিল্লা বিয়ের মাধ্যমে আবারও সংসার শুরু করা সম্ভব।

 

জামিলা সরাসরি বিল্লালকে বলে দিয়েছে যে এরপর যদি সে তাকে ফোন করে তবে সে পুলিশে খবর দেবে। এভাবে আর বিরক্ত না করার জন্য সে সাবধান করে দিয়ে ফোনটা কেটে দেয়।

 

দুইমাস বেশ নিশ্চিন্তেই কাটে জামিলার। তৃতীয় মাসের শুরুতেই বিল্লাল আবারও জামিলাকে ফোন দেয়। এবার অবশ্য সে ফোন ধরে না। যতবার কল আসে ততবার সে কল কাটতে থাকে। পরে জামিলা নতুন নাম্বার নিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে।

 

কিন্তু বিল্লাল জামিলার পেছনে আঠার মত লেগে আছে। সে কেমন করে যেন জামিলার নতুন নাম্বার পেয়ে আবারও ফোন দেয়। জামিলার কাছে বিল্লালের নাম্বারটা মুখস্থ থাকায় সে ফোন না ধরে যথারীতি কাটতে থাকে।

 

ফোন ধরছে না দেখে বিল্লাল জামিলার বাসার সামনে এসে অগোচরে লুকিয়ে থাকে এই আশায় যে তার সাথে সামনাসামনি দেখা হলে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে। এভাবে কয়েকদিন জামিলার বাসার আশেপাশে অপেক্ষা করে কোনও ফল হয়নি।

 

ভাগ্য অবশ্য তাকে আর বঞ্ছিত করেনি। একদিন বিল্লাল জামিলাকে একটা রিক্সায় করে বাইরের দিকে যেতে দেখে। বিল্লাল আড়ালে থাকায় জামিলা তাকে দেখতে পায়নি। সে তাড়াতাড়ি একটা রিক্সা ডেকে জামিলার রিক্সার পিছু যেতে থাকে।

 

কিছুদূর গিয়ে বিল্লালের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যায়। সে জামিলার রিক্সার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। জামিলা তাকে দেখে অবাক। সে রিক্সাওয়ালাকে এগিয়ে যেতে বলে কিন্তু বিল্লাল রিক্সার হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলে,

 

- জামিলা নাম রিক্সা থেকে। তোর সাথে কথা আছে।


- আমি নামবো না। আমার কাজ আছে।


- কি কাজ?


- সেটা তোমাকে বলবো কেন? 


- বললে সমস্যা কি?


- তুমি আমার কে হও যে তোমাকে সব বলতে হবে?


- আমি তোর কেউ না?


- না।

 

        ট্রেনের গতি যেমন ধীরে ধীরে বেড়ে চলে, তেমনই বিল্লাল এবং জামিলার গলার স্বর ধীরে ধীরে উঁচু হতে থাকে। যেন রাস্তার মাঝখানে দুইজন চরম ঝগড়ায় লিপ্ত। রিক্সাওয়ালা কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সে কপালের শিশির বিন্দুর মত জমে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে একবার জামিলার দিকে তাকায়, একবার বিল্লালের দিকে তাকায়।        

 

        আশেপাশে মানুষের জটলা হয়ে গেছে। অবস্থা এমন যেন বানরের খেলা চলছে আর তাকে ঘিরে তামাশাপ্রিয় মানুষেরা ভিড় করে আছে। একপর্যায়ে বিল্লাল জামিলার হাত ধরে টান দেয়। সে তাকে রিক্সা থেকে নামিয়েই ছাড়বে এমন অবস্থা। কিছু ভালো মানুষের হস্তক্ষেপে জামিলা সে যাত্রায় ঠিকঠাক মত তার গন্তব্যে পৌঁছে যায়।

 

        কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে সে মনে মনে সহস্রবার আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করেছে যাতে রাস্তায় তাকে আবারও মান সম্মান খোয়াতে না হয়। দুইদিন পর বিল্লাল ফোন দেয়। এবার জামিলা ফোন ধরে শেষবারের মত তাকে সাবধান করে দেয়। এরপর যদি কখনও এমন ব্যবহার করে তবে সে আইনের সাহায্য নিতে বাধ্য হবে।

 

        এ কথা শুনার পর বিল্লাল বলে যে ঠিক আছে সে আর এমন কখনও করবে না তবে সে তার ছেলে জায়েদকে তার সাথে নিয়ে যেতে চায়। জায়েদ হচ্ছে জামিলার জীবন। সে থাকা মানেই জামিলার বেঁচে থাকা। জায়েদ তার কাছে হীরার টুকরার মতই মূল্যবান। সে কোনোমতেই তাকে হারাতে পারবে না।

 

        জামিলা মুখের উপর অসম্ভব শব্দটি উচ্চারণ করে ফোন কেটে দিয়েছে। এরপর একদিন বিল্লাল আবারও জামিলাকে পথে আটকায়। সে তাকে বিভিন্ন রকম হুমকি দিতে থাকে। জামিলা কথা না বাড়িয়ে সরাসরি থানায় গিয়ে একটি জিডি করে।

 

        বিল্লালকে খুঁজে পেতে পুলিশের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। সে এখন শ্রীঘরে। তার দিন কাটে অন্যান্য কয়েদীদের সাথে কথা বলে এবং নির্ঘুম রাত কাটে মশার কামড় খেতে খেতে। তার এ বোধোদয় হলেই মঙ্গল যে, বাড়াবাড়ি ভালো নয়।

View kingofwords's Full Portfolio