ডাইনী [Bangla Story]

এক ভয়ংকর কুৎসিত দর্শন ডাইনী বাস করতো আমাদের রসুলপুর গ্রামে। শতবর্ষী বট গাছের সুশীতল ছায়াতলে যে জরাজীর্ণ কুঠি বাড়ি আজো কালের সাক্ষী হয়ে পিরামিডের মত দাঁড়িয়ে আছে, সেই বাড়িটিতেই ছিল নিষ্ঠুর ডাইনীর বাস। আমি নিজে কখনও তাকে দেখিনি, তবে লোকমুখে শুনেছি।  

 

        শুরুতে যখন মানুষ সেই ডাইনীর সম্পর্কে নানান ভয়ানক সব কথা বলতো, কেন জানি আমার একটুও            বিশ্বাস হতো না। যদিও আমি সবার কথাই বেশ গাম্ভীর্যের সাথেই শুনতাম; যখন তাদের মুখে ডাইনীকে ঘিরে সেইসব ভৌতিক কাহিনীর খই ফুটতো, তখন আমি মনে মনে হাসলেও আমার মুখে একটুও হাসির রেখা ফুটে উঠতো না কারণ আমি তাদের দৃঢ় বিশ্বাসে কখনই আঘাত দিয়ে মনে কষ্ট দিতে চাইতাম না।

 

        এমন ভূত, প্রেত, ডাইনী ইত্যাদির কথা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগলেও এসবের উপর আমার কখনও বিন্দুমাত্র বিশ্বাস কখনও ছিল না, এখনও নেই। কারণ আমার মধ্যে শিক্ষার আলো আছে, আছে বিজ্ঞানের যুক্তিও। তাই আমি এমন আজগুবি গল্পে কখনও আস্থা রাখতে পারি না। তাছাড়া আমিতো কখনও কোনও ভূত বা ডাইনীকে স্বচক্ষে দেখিনি, তাই কিভাবে এসবের উপর আমি বিশ্বাস করি?

 

        একদিন শোয়েব মোল্লা গ্রামের একজন বিদ্বান লোকের সাথে দেশ ও বিশ্বে ঘটে চলা নানান বিষয় নিয়ে আলাপের এক পর্যায়ে আমি সেই ভৌতিক কুঠি বাড়ির কথাটি ইচ্ছে করেই তুললাম। আমার মনের তীব্র বাসনা এই যে সেই কথিত ডাইনীর ব্যাপারে তার কি অভিমত তা জানার চেষ্টা করা। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তিনিও আমার মত এসব কাহিনীকে হেসেই উড়িয়ে দেবেন! আমি বিনীতভাবে তাকে প্রশ্ন করলাম,    

 

- আচ্ছা, ঐ ভৌতিক কুঠি বাড়ি সম্পর্কে আপনার কি মত?


- কোনটা?


- ঐ যে বট গাছের নীচেরটা।


- হ্যাঁ, অনেকেতো সেটা নিয়ে অনেক কথাই বলে।


- আপনি কি এসবে বিশ্বাস করেন?


- খুব কঠিন প্রশ্ন করে বসলে দেখছি?


- না, মানে আমার খুব জানার ইচ্ছা এই যে আপনি এসব নিয়ে কেমন বিশ্বাস পোষণ করেন?


- সত্য বলতে কি আমি সেই ডাইনীকে ঘিরে যেসব গল্প মানুষের মাঝে প্রচলিত আছে তার সবগুলোকে বিশ্বাস না করলেও কিছু কিছুর উপর বিশ্বাস করি।


- মানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না! আপনিও বিশ্বাস করেন যে সেই ডাইনী সত্যিই কুঠি বাড়িতে আছে?


- তোমার এই প্রশ্নের উত্তর এক লাইনে দেয়া সম্ভব নয়। যদি বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে চাও তবে আমি তোমাকে একটি গল্প শোনাতে চাই যদি তোমার হাতে সময় থাকে।


- আমার সময় আছে, আমি শুনতে চাই। আপনি দয়া করে বলুন।

 

        তারপর শোয়েব মোল্লা গল্পটি শুরু করলেন আর আমি বাধ্য ছেলের মত পিন পতন নীরবতা বজায় রেখে তার মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটি শব্দ মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম। তিনি বললেন,

 

        সেই ব্রিটিশ আমলে কুঠি বাড়িটিতে একজন কামুক এবং চরিত্রহীন জমিদার বাস করতেন। তার নাম ছিল হাবীব হাসান। সে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যাকে তাকে মারধর করতো, যখন ইচ্ছা নিরীহ মানুষের কাছ থেকে জোর করে জায়গা জমি ছিনিয়ে নিতো। গ্রামের যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে তার সম্মুখে নাচতে বাধ্য করতো, তার সাথে সহবাস করতে বাধ্য করতো; রাজী না হলে ধর্ষণ করে হত্যা করে সেইসব যুবতী নারীদের নগ্ন শরীর ঐ বটগাছে ঝুলিয়ে রাখতো।

 

সাধারণ এসব দেখেও না দেখার ভান করতো; যদি কেউ তার কথার বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করতো কিংবা তার কথার বরখেলাপ করতো, তাহলে সাথে সাথেই ধারালো তরবারি দিয়ে সবার সামনে সেই মানুষটির ধড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেলতো!     

এমন অন্যায় অনাচারের মাঝে স্বর্গীয় দূতের মতন একজন মহীয়সী নারীর আবির্ভাব হয়। তার নাম দ্যুতি ইসলাম। তার বাড়ি কোথায়, সে কি করতো এসব সম্পর্কে কারো কোনও ধারণাই ছিল না, এখনও নেই। যাইহোক, সেই নারী একদিন বিকেলে নদীর ঘাটে বসে পানিতে নিজের পা ভিজিয়ে বসেছিলেন। ঠিক ঐ মুহূর্তে হাবীব যথারীতি মাতলামি করে তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে ঘরে ফিরছিল। হঠাৎ সুন্দরী দ্যুতির উপর তার দৃষ্টি পড়ে। দ্যুতির পরনে একটি শাড়ি ছিল; তার কচি বাঁশের মতন চিকন কোমর দেখা যাচ্ছিল; দুধের মত সাদা চামড়ায় যেন হাবীবের নজর আঠার মতন আটকে ছিল।

 

দ্যুতি অন্য লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে যাবার জন্য উদ্যত হলে হাবীব শয়তানের মতন তার পথ আগলে দাঁড়ায়,    

 

- দাঁড়াও!


- কেন?


- কে তুমি?


- আমার নাম দ্যুতি।


- তোমাকে তো এই এলাকায় আগে কখনও দেখিনি!


- আমার বাড়ি অনেক দূরে। এখানে একটি কাজে এসেছি।


- কি কাজ?


- তা তো বলা যাবে না!


- কি? এতো বড় সাহস? আমার প্রশ্নের উত্তর না দেয়ার মত দুঃসাহস তোমার হয় কি করে? তুমি কি জানো যে এই মুহূর্তে আমার তরবারি দিয়ে তোমাকে দুই টুকরা করে ফেলতে পারি?


- আমি এমন অন্যায় কিছু বলিনি যে আপনি আমার প্রাণ হরণ করবেন, তাই না?

 

        তৎক্ষণাৎ আর কোনও কথা না বাড়িয়ে হাবীব তার লোকদেরকে আদেশ দেয় যাতে দ্যুতিকে কুঠি বাড়ির অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হাবীব তাকে ধর্ষণ করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। দ্যুতি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে কাঁদতে কাঁদতে অভিশাপ দেয় যে হাবীবের স্ত্রীর একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেবে যে ভূমিষ্ঠ হয়ে এক ভয়ানক ডাইনীতে পরিণত হবে এবং তার এই নিষ্ঠুরতার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একে একে শেষ করবে।  

 

        ঐ সময় হাবীব মৃতপ্রায় দ্যুতির মুখে শোনা এই কথাগুলোতে মোটেও পাত্তা দেয়নি। বরং সে এ কথা শুনে হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাবার যোগাড় হয়েছিল! হাবীবের স্ত্রী তানিয়া সুলতানা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েই মারা যায়। মৃত স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে হাবীব মারাত্মকভাবে ঘাবড়ে গিয়েছিল। প্রথমত দ্যুতির কথামত সে কন্যা সন্তানের বাবা হলো, দ্বিতীয়ত তার স্ত্রীর মৃত্যু হলো। হাবীব মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে ভাবতে লাগলো যে এখন কি তার পালা নাকি?

 

        হাবীব তার কন্যার নাম রাখে আলেয়া। তার বয়স যখন ১৬, তখন এক রাতে সে একটি ছুরি নিয়ে তার পিতার কক্ষে গিয়ে মুহুর্মুহু ছুরির আঘাতে তাকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করে। সেই থেকে লোকমুখে এই কথাটি প্রচলিত হয়েছে যে ঐ কুঠি বাড়িতে আলেয়ার প্রেতাত্মা আজো মেঘের মতন ঘুরে বেড়ায়! যদি কেউ সেই বাড়িতে সূর্যাস্তের পর প্রবেশ করে, তবে সে আর কখনও ফিরে আসে না! তার লাশটাও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রথম প্রথম এসবে কথায় আমার হাসি পেলেও যখন থেকে আমার নিজের ছেলে তুহিন সেই কুঠি বাড়িতে গিয়ে নিখোঁজ হয়, তখন থেকে আমি সেই ডাইনীর সম্পর্কে প্রচলিত প্রতিটি কথাই বিশ্বাস করি। এখন তুমি বিশ্বাস করো কিংবা না করো এটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

 

        এ কথার মাধ্যমে ডাইনী সম্পর্কে শোয়েব মোল্লা তার বক্তব্যের ইতি টানেন। আমি দার্শনিকের মতন ভাবতে থাকি। আমার ভাবনারা মেঘ হয়ে মনের আকাশে এলোমেলোভাবে উড়তে থাকে যেন তাদের কোনও বিশ্রাম নেই! আমি যুক্তি এবং বিজ্ঞানের দ্বারা হিসেব মেলাতে চেষ্টা করি, কখনও মেলে, কখনও মেলে না!

 

            ‘ডাইনী বলে কিছু আছে নাকি নেই- শেষ পর্যন্ত এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসি- আমি ঐ আলেয়া নামক ডাইনী সম্পর্কে একটি বই লিখবো যাতে মানুষের কাছ থেকে শোনা সকল তথ্যের সুষ্ঠু উপস্থাপনা থাকবে। উপসংহারে অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ছটা থাকবে!    

View kingofwords's Full Portfolio
tags: