প্রকৃতির খেয়াল [Bangla Story]

        বৃষ্টির আশায় আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছে জমশেদপুর গ্রামের প্রবীণ কৃষক সাত্তার মিয়া। প্রচণ্ড গরমে কাক যেমন একফোঁটা জলের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকে ঠিক তেমন।

 

        গ্রামের অন্যান্য কৃষকদেরও একই অবস্থা। সকলেই অপেক্ষা করছে তো করছেই। অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না। আকাশে মেঘের অবিরাম অনুপস্থিতি প্রত্যেক কৃষকের হৃদয়ে উত্তপ্ত লোহার ছেঁকার মতন লাগে।

 

        প্রত্যেক কৃষক প্রতিদিন আল্লাহ্‌র দরবারে মোনাজাত করে যায়। তাদের সবারই আশা এই যে খুব দ্রুত প্রবল বর্ষণে নদী নালা মাঠ ঘাট সিক্ত হবে। চারিদিকে সতেজতা বিরাজ করবে। ক্ষেতে আসবে প্রাণ; নতুন বীজ রোপণ করা যাবে। অতি শীঘ্রই সমস্ত গ্রাম পূর্বের মতই সবুজে ভরে উঠবে।

 

        কিন্তু বৃষ্টি তো আসে না। ইতোমধ্যে এক সাধু বাবার পরামর্শে একটি গরু উৎসর্গ করা হয়েছে। তাতেও ফলাফল শূন্য! এদিকে একাধারে এতোদিন বৃষ্টি না হবার ফলে ক্ষেতের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। খাবার পানির সঙ্কটও চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। ধীরে ধীরে গ্রামে দুর্ভিক্ষের ভয়াল ছায়া পড়তে শুরু করেছে। প্রচণ্ড গরমের ফলে গাছের পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে; নলকূপেও আগের মতন আর পানি উঠে না। গরু বাছুরও খাদ্যের অভাবে শুকিয়ে কংকালের মত হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও কিছু গবাদি পশু মারা যাবারও খবর পাওয়া যাচ্ছে।

 

        এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে সাত্তার অন্ধের মতন দিশেহারা অনুভব করে। তার পরিবারে আছে তার স্ত্রী শাকেরা বানু, দুই ছেলে জাবেদ, জায়েদ এবং এক মেয়ে সিতারা বানু। সাত্তার তার গরু বাছুর নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে ঠিকই কিন্তু তার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে তার পরিবারের সদস্যদের নিশ্চয়তা প্রদানের বিষয়টি। একদিন সাত্তারকে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকতে দেখে তার শাকেরা বলে,

 

- এতো চিন্তা কইরো না। দেইখো সব ঠিক হইয়া যাইবো। আল্লায় যা করেন ভালার লাইগাই করেন।

- চিন্তা কি আর সুখে করি শাকেরা। চিন্তাতো মাথার ভিতরে আইয়া পড়ে। তাছাড়া চিন্তা না কইরা কি আর উপায় আছে কও?

- আল্লার উপরে ভরসা রাখো, তিনি সব ঠিক কইরা দিবেন।

- আল্লার উপরে ভরসাতো আছেই। কিন্তু পোলা মাইয়ার দিকে চাইয়া দেখলে আর কিচ্ছু ভাল্লাগে না। মনে হয় এই গেরাম ছাইড়া অন্য কোনওখানে যাইগা।

- কি যে কও না তুমি? নিজের ঘরদুয়ার ছাইড়া কই যাইবা? যাওনের কি আর জায়গা আছে?

- তা তুমি ঠিকই কইছো বউ। কিন্তু এইখানে থাইকাওতো কোনও লাভ হইতাছে না! হুনছি পাশের গেরামের মাইনষে নাকি দলে দলে ঢাকার দিকে রওনা দিতাছে।

- ঢাকায় যাইয়া কি হইবো।

- ঢাকায় গেলে কোনও না কোনও কাজকাম কইরা খাওন যাইবো এই আশায় হক্কলতে মিল্লা ঢাকার দিকে যাইতাছে। লও আমরাও ঢাকা যাই!

- না, না, আমার ঢাকা যাওনের কোনও ইচ্ছা নাই! অচেনা অজানা জায়গা! আর গেলেই কি কাম পাওন যাইবোনি?

- বড় শহর, কামের অভাব হইবো না। কিছু দিনের লাইজ্ঞা যাওন যায়। আমরার গেরামের অবস্থা ভালা হইলে আবার আমরা গেরামে আইয়া পরমু, কি কও?

- চিন্তাডা মন্দ না। দেখো যেইডা ভালা হয়!

 

        অতঃপর সাত্তার তার পরিবার নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। ঢাকা মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধের মতন আকর্ষিত করে ঠিকই কিন্তু এর চাকচিক্যের আড়ালে কত মানুষ যে প্রতিদিন শেষ কালের গহ্বরে হারিয়ে যায় সে হিসেব কেউ রাখে না!

 

        কিন্তু সাত্তার যে আজ বড্ড অসহায়! সেই জন্ম থেকেই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে অবিরত লড়াই করেই যাচ্ছে। বানর যেমন গাছের এক ডাল থেকে লাফিয়ে অন্য ডালে যায়, সাত্তারও যেন তার পরিবার নিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। এছাড়া যে তার আর কিছুই করার নেই।

 

        জীবন কঠিন, কিন্তু জীবনের পরীক্ষায় হেরে গেলে জীবন কঠিনতর হয়ে যায়। সাত্তার এখনও হার মানেনি ঠিকই কিন্তু মাঝেমাঝে তার বুকে অতৃপ্তি এবং বিষাদের কালো ছায়া এমনভাবে জেঁকে বসে যে তখন তার মনে হয় যেন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কোনও এক নির্জনে চলে যেতে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই কি সবসময় উপায় হয়?

 

        যাইহোক, সাত্তার তার পরিবার নিয়ে রওনা হয়। বাসে করে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা এখন পর্যন্ত বেশ ভালোই। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা যাত্রা করার পর বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বিশাল ট্রাকের সাথে বাসটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়াতে বাসের প্রায় সকল যাত্রীই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

 

        রক্তাক্ত দেহ কোনও মতে নাড়িয়ে সাত্তার তার স্ত্রী এবং সন্তানদের খুঁজতে থাকে। লাশের স্তুপের মাঝ থেকে তাদের কারো সাড়াশব্দ পায় না। সে যে সজোরে চিৎকার দিয়ে তাদের নাম ধরে ডাকবে সেইটুকু শক্তিও তার দেহে অবশিষ্ট নেই।

 

        সাত্তার বুকে পাহাড় সমান কষ্ট নিয়ে মনে মনে বলছে, হে আল্লাহ্‌! সবাইরে নিয়া গেলা যখন, আমারে কেন নিলানা?  

View kingofwords's Full Portfolio
tags: