ন্যায়বিচারের কান্না! [Bangla Story]

         অনেক কষ্টে কামাল মিয়া ডাকঘরে কেরানির চাকরিটা পেয়েছে। চাকরি পাবার পর থেকে তার পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা খুব বেশী না আসলেও আগের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় আছে এ কথা বলাই যায়।

 

        কামালের স্ত্রী জরিনা বেগম একজন গৃহিণী। তাদের একমাত্র সন্তানের নাম আকবর মিয়া। তার বয়স চার বছর। একদিন ইকবাল আহমেদ নামে ডাকঘরের এক কর্মকর্তার মানিব্যাগ চুরি গেলে তিনি এর জন্য কামালকে দায়ী করেন। কামাল যতবারই বলে যে সে চুরি করেনি, ততবারই তিনি তাকে চোর বলে সম্বোধন করতে থাকেন।

 

        যদিও ইকবালের মানিব্যাগ চুরি যাবার সময় তিনি নিজে কিংবা অফিসের অন্য কেউই স্বচক্ষে দেখেননি, তবুও অন্যরাও ইকবালের পক্ষ নিয়ে সজোরে বলতে থাকেন যে কামালই চোর! দুঃখে, কষ্টে আর লজ্জায় কামাল যে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ঐদিন কোনোরকমে নিজের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে গোমড়া মুখে বিছানায় শুয়ে থাকে। স্বামীকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে জরিনা বলে,

 

- তোমার কি হয়েছে?

- কিছু না!

- তাহলে এমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন?

- সে কিছু না, এমনি।

- তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে, দেখি জ্বরটর আসছে কিনা?

- বললামতো কিছুই হয়নি।

- আমার উপরে কোনও কারণে রাগ করেছো নাকি?

- না, তোমার উপর রাগ করতে যাবো কেন? তুমিতো রেগে যাবার মত কিছু করোনি তাই না?

- অফিসে কোনও ঝামেলা হয়নিতো?

- সামান্য একটু সমস্যা হয়েছে।

- আমার সাথে শেয়ার করো, দেখবে তোমার দুশ্চিন্তা অনেকটা কেটে যাবে।

- আজ অফিসে একজন স্যারের মানিব্যাগ চুরি হয়েছে।

- কে চুরি করেছে?

- চোর কে সেটি খুঁজে বের করার আগে কোনও প্রমাণ ছাড়াই সবাই আমার দিকেই আঙুল দেখাচ্ছে!

- মানে?

- মানে এই যে আমি নাকি মানিব্যাগ চুরি করেছি!

- তুমি শক্ত করে বলোনি যে এমন মিথ্যা অপবাদ দেয়া মোটেই উচিৎ নয়!

- বলেছি, কিন্তু বলে কি কোনও লাভ আছে বলো? অফিসের সবাই একজোট হয়ে আমাকেই দায়ী করছে। যে কাজটি আমি করিইনি সে কাজটির জন্য আমাকেই দায়ী করা হচ্ছে!

- চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আসল চোর ধরা পড়বে। তখন সবাই জানবে যে তুমি নির্দোষ।

- আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করি যেন তাই হয়।

 

        পরদিন কামাল যথারীতি ডাকঘরে কাজ করতে গেলে পোস্টমাস্টার তাকে ডেকে নিয়ে বলেন,

 

- ইকবাল তোমার নামে মামলা করেছে। ইকবালের দাবী এই যে মানিব্যাগে প্রায় দশ হাজার টাকা ছিল। তিনি নাকি নিশ্চিত যে তুমিই এই চুরির জন্য দায়ী।       

- কিন্তু স্যার, আমি চুরি করিনি। আমি চোর নই। আমার জীবনে কখনও ছোটখাটো চুরিও করিনি। আপনি আমার পরিচিত কাউকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন।

- দেখো কামাল, এখন এসব বলে আর কি লাভ? যা হবার তাতো হয়েই গেছে। যেহেতু ইকবাল মামলা করেছেন, সেহেতু মামলার চূড়ান্ত সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তোমাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

- এ আপনি কি বলছেন স্যার?

- দেখো, আমার কিছুই করার নেই। আমিতো নিয়মের বাইরে যেতে পারবো না, তাই না?

- কিন্তু আমিতো চুরি করিনি স্যার!

- যদি কোর্টে তুমি নির্দোষ প্রমাণিত হও তবে তুমি আবার তোমার চাকরি ফিরে পাবে। কিন্তু তার আগপর্যন্ত তোমাকে নিয়ম মানতেই হবে।

- স্যার চাকরি ছাড়া আমি পরিবার চালাবো কিভাবে?

- দেখো কামাল, তোমার প্রতি আমার সহানুভূতি থাকলেও এই মুহূর্তে আমার কিছুই করার নেই।

 

        অতঃপর কামালের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এই অধ্যায়ে সুখের পরিবর্তে দুঃখের পাল্লাই অনেক বেশী। যেহেতু চাকরি নেই, সেহেতু কামাল বাসা ভাড়া ঠিকমত দিতে পারছে না বলে বাড়িওয়ালা দ্রুত তাকে বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে। উপায়ান্তর না দেখে কামাল স্ত্রী এবং ছেলেকে নিয়ে গ্রামে ফিরে যায়। সেখানে নিজের একটি কুঁড়েঘরে আশ্রয় নেয়। পাশাপাশি গ্রামে ছোটখাটো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে।

 

        ইতোমধ্যে কয়েকবার কোর্টে গিয়ে উকিলের সাথে পরামর্শ করেছে। উকিল তাকে প্রতিবার আশ্বস্ত করেন যে এই মামলায় কামালের জয় সুনিশ্চিত। কিন্তু দিনের পর দিন কোর্টে যাওয়া আসা করতে করতে দুই বছর কেটে যায়। শুনানির দিন বিবাদী সময়মত উপস্থিত থাকলেও বাদীর দেখা মেলে না! সরকারি উকিলের অনুরোধে জজসাহেব একটির পর একটি শুনানির তারিখ দিতেই থাকেন, সুদূর গ্রাম থেকে কামাল অনেক কষ্ট করে আসতে থাকে, কিন্তু এই মামলার কোনও সুরাহা হয় না।

 

        ইতোমধ্যে কামাল একবার সেই ডাকঘরে গিয়ে ইকবাল সাহেবকে বিনীত অনুরোধ করে যাতে একটিবার কোর্টে যান। তিনি গেলেই মামলাটি দ্রুত নিস্পত্তি হবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু কামালের কথা শুনে ইকবাল রীতিমত রেগে গিয়ে ডালিমের মতন লাল হয়ে যান। তিনি কামালকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে তাকে বের করে দেন।

 

        আরও তিনটি বছর কেটে যায়। কামাল এখন বয়সের ভারে ক্লান্ত। ঠিকমত হাঁটতেও পারে না। কোর্টে যাওয়া আসা করার মতন শক্তিও তার দেহে অবশিষ্ট নেই। তার ছেলে আকবর শহরে ওয়েল্ডিং-এর দোকানে কাজ করে বলেই পরিবারটি এখনও কোনোরকমে টিকে আছে। ছেলে অর্থ পাঠানো বন্ধ করলে হয়তো বৃদ্ধ বয়সে কামাল এবং তার স্ত্রীকে ভিক্ষে করে খেতে হতো।  

 

        একদিন কামালের বাসায় পুলিশের গাড়ি আসে। পুলিশ কর্মকর্তা কামালকে গ্রেপ্তার করেন কারণ কামাল গত তিনটি শুনানিতে কোর্টে যায়নি। আইনের মারপ্যাঁচ জিলাপির প্যাঁচের চেয়েও অনেক বেশী জটিল! কামালের আফসোস আরও বহুগুণে বেড়ে যায় কারণ যিনি মামলা করলেন তিনি একটিবারও কোর্টে না গিয়েও বহাল তবীয়তে আছেন; অন্যদিকে বছরের পর বছর নিয়ম মেনে কোর্টে উপস্থিত থাকার পরও শারীরিক অসুস্থতার কারণে কয়েকটি দিন অনুপস্থিত থেকেছে বলে তাকে কারাগারে পাঠানো হলো! এ কেমন বিচার?

 

        কামালের উকিল, স্ত্রী এবং ছেলে নিয়মিত তার সাথে জেলে দেখা করে উৎসাহ দিয়েই যাচ্ছে। এসবের মাঝেই একদিন কামালের হার্ট এ্যাটাক হয়। হাসপাতালে নেয়ার পরপরই তার মৃত্যু হয়। জরিনার দৃঢ় বিশ্বাস এই দুনিয়ায় সুবিচার না পেলেও পরকালে তার স্বামী নিশ্চয়ই সুবিচার পাবে। 

View kingofwords's Full Portfolio
tags: