নিষ্ঠুর! [Bangla Story]

      জাহেদ বন্ধুদের সাথে মাঠে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। এদিকে তার দরিদ্র বাবা ইয়াসিন এবং মা জোহরা চিন্তায় অস্থির। স্বাভাবিকভাবেই তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। সন্ধ্যার পরেও যখন জাহেদ বাসায় আসেনি, তখন ইয়াসিন জাহেদের বন্ধুদের কাছে খোঁজ করার জন্য তাদের বাসায় যায়। কিন্তু সবাই শুধু একই কথা বলে যে মাঠে ক্রিকেট খেলার পর যে যার ঘরের দিকেই ফিরে গেছে।

 

        এমন অবস্থায় ইয়াসিন যে কি করবে কোনও কিছুই মাথায় আসে না। ওদিকে জোহরা দুশ্চিন্তায় কেঁদে কেটে অস্থির। ঘরের পাশের দোকানদার জলিলের সাথে কথাটা শেয়ার করার পর তার পরামর্শে ইয়াসিন নিকটবর্তী থানায় যায়।

 

        শুরুতে জোহরাও সাথে যেতে চেয়েছে কিন্তু ইয়াসিন তাকে সঙ্গে নেয়নি। যাইহোক, গরীব কৃষক ইয়াসিনের কথা শোনার মত ধৈর্য এবং মানতবতাবোধের অভাব আকাশের মেঘের মতই স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। যে পুলিশ অফিসার শিশু জাহেদের কথা শুনছেন তার ভাবখানা দেখে মনে হয় যেন তিনি এক লাটসাহেব! ইয়া মোটা পেট দেখতে ঠিক ঢোলের মতন! মুখভর্তি পান চিবিয়েই যাচ্ছেন আর কিছুক্ষণ পরপর পানের পিক টেবিলের পাশে ফেলছেন।

 

        ইয়াসিন কাঁদো কাঁদো গলায় কথাগুলো বলে চলেছে- জাহেদের বয়স সাত বছর, দেখতে এমন, পরনে এমন পোশাক ছিল ইত্যাদি। কিন্তু তার মনে হয় না যে অফিসারটি তার কোনও কথাই মন দিয়ে শুনছেন। অথচ সে কথা বলা অবস্থায় একজন ধনী লোক এসে প্রবেশ করলে সাথে সাথে অফিসারটি দাঁড়িয়ে তাকে বসার জন্য বলেন। লোকটি কি যেন একটা সমস্যায় পড়েছেন। শীঘ্রই একটি সমাধান চান। সমস্যা খুব গুরুতর না হলেও অফিসারটি ঐ ধনী ব্যক্তির কথা এমন মনোযোগের সাথে শুনছেন যেন সমস্যা খুব মারাত্মক! কথার মাঝখানে ইয়াসিনকে হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে আবার ঐ ধনী লোকটির কোথায় মনোযোগ দিতে থাকেন। এই কি আইনের শাসন? এই কি বিচার? দরিদ্রদের কাছে বিচার দূরের সেই চাঁদ, যেটিকে পাওয়ার আশায় তাদের দিন কাটে কিন্তু ধনিদের কাছে বিচার রুমালের মত, সেটিকে খুব সহজেই পকেটে রাখা যায়!

 

        থানার ভেতরে যখন ইয়াসিন ছেলে হারানোর কথাগুলো বলছিল তখন কিন্তু সে একটুও কাঁদেনি; কিন্তু ঐ পুলিশ অফিসারটির দ্বিমুখী আচরণ তার হৃদয়টাকে কসাইয়ের দায়ের কোপের মত দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছে। যে পুলিশরাই পারে তার জাহেদকে খুঁজে আনতে, সেই পুলিশরাই যদি বিষয়টিকে কোনও গুরুত্বই না দেয়, তবে সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

 

        জোহরা ইয়াসিনের ফিরে আসার জন্য চাতক পাখির মত অপেক্ষারত। ইয়াসিন অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয় নিয়ে বাসায় ফিরে আসে। সে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই জোহরা দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করে-

 

- পুলিশরে জানাইছো?

- হ।

- কি কইল পুলিশে?

- কইছে খুঁইজা দেখবো।

- আমার পোলাডা যে কই আছে? কি করতাছে? কে যে ধইরা লইয়া গেল তারে?

- পুলিশের উফর ভরসা কইরা লাভ নাই!

- এইডা তুমি কি কও জাহেদের বাপ?

- ঠিকই কইছি।

- মানে?

- পুলিশের কথাবার্তায় মনে হইল তারা কুনো গুরুত্বই দিতাছে না।

- তাইলে কি আমি আর কুনোদিনই আমার বুকের ধন জাহেদরে দেখুম না!

- অহন আল্লাই একমাত্র ভরসা। বেশী বেশী কইরা আল্লারে ডাহো!

 

        ঝরে পড়া পাতা বাতাসে উড়ে উড়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার মত দিন যায়, দিন চাকার মত গড়িয়ে গড়িয়ে মাসে গিয়ে পড়ে, মাস গিয়ে বছরে। ইতোমধ্যে কতবার যে ইয়াসিন এবং জোহরা থানায় গেছে তার হিসেব নেই! পুলিশরাও বিরক্ত বোধ করেন। তারা এমন ভাব করেন যেন হারানোর ছেলের খোঁজে আসেনি, টাকা চাইতে এসেছে!

 

        দুই বছর পর পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি সব হারায়। ক্ষুধার্ত পদ্মা যেন এনাকোণ্ডার মত ধীরে ধীরে সব গিলে ফেলে! পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে ইয়াসিন ও জোহরা ট্রেনে করে ঢাকায় যাত্রা করে। তাদের বিশ্বাস যে ঢাকার মত বিশাল শহরে কোনও না কোনও কাজের সন্ধান নিশ্চয়ই পাবে।

 

        ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছানোর সময় হঠাৎ একটি অন্ধ ছেলে ঘুমন্ত জোহরার পাশে এসে দুইডা টেহা দেন, ভাত খামু বলতে থাকে। ইয়াসিন তখন জানালার বাইরের সবুজ সুন্দর বাংলাদেশের রূপ দেখায় ব্যস্ত। সে ভিখারি ছেলেটির গলা শোনামাত্রই জাহেদের কথা মনে পড়ে যায়। এ যে হুবহু যাহেদের গলা!

 

        ইয়াসিন সাথে সাথে ছেলেটির দিকে ফিরে তাকায়; তার চেহারা ভালো করে দেখার আগেই ছেলেটি বগির ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড়ে মিশে যায়! ইয়াসিন উঠে গিয়ে ছেলেটিকে খুঁজতে থাকে। খুব বেশী দূর যেতে হয় না তার। কাছেই পেয়ে যায়। ছেলেটির পিঠে আলতো স্পর্শ করতেই সে পেছন ফিরে তাকায়।

 

ইয়াসিনের ভূত দেখার মত শিহরিত হয়ে নির্বাক হয়ে দাঁড়ানো! এ যে তারই হারানো আদরের ছেলে জাহেদ যার চোখ নেই! অন্ধ জাহেদ তার বাবার দিকেই হাত বাড়িয়ে আছে দুই টাকার জন্য! ও জাহেদ রে, আমার জাহেদ বলে ইয়াসিন তাকে পরম আদরে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে!

View kingofwords's Full Portfolio
tags: