ছেলেধরা! [Bangla Story]

       এমন একটি দুঃসংবাদের জন্য আমজাদ সাহেব মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি মনোযোগের সাথে অফিসে কাজ করছিলেন আর ঠিক তখনই একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে একটি কল আসে ওনার ফোনে। যাইহোক, তিনি ফোনটা রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে একটি বেশ গম্ভীর কণ্ঠস্বর ওনার কানে আসে। লোকটি বলে-

 

- আপনি কি আমজাদ বলছেন?

- জি বলছি। আপনি কে বলছেন প্লিজ?

- আপনি আমাকে চিনবেন না।

- আমাকে কেন ফোন করেছেন দয়া করে বলবেন?

- আপনার ছেলে সাজিদকে আমরা অপহরণ করেছি!

- আপনি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন নাকি?

- আপনার কি মনে হচ্ছে আমি আপনার সাথে মশকরা করছি! তাহলে স্কুলে ফোন দিয়ে দেখুন আপনার ছেলে ক্লাসে আছে কি না! আমি একটু পরে আবার ফোন করব।

 

        এ কথা শোনার সাথে সাথে আমজাদের হৃদয়ে একটু চিনচিন ব্যথা শুরু হয়ে যায়। ওনার মনে হয় কেউ যেন একটি আলপিন দিয়ে ওনার হৃদয়ে একটু পরপর খোঁচাচ্ছে! তাড়াতাড়ি সাজিদের স্কুলে ফোন করে নিশ্চিত হতে চায় সে ওখানে আছে কি না।

 

        দুর্ভাগ্যজনকভাবে অফিস থেকে জানানো হয় যে সাজিদ আজ স্কুলে যায়নি। এ কথা শোনার পর আমজাদ সাহেব আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। ওনার মাথায় যেন বাজ পড়েছে! দুশ্চিন্তায় তিনি ঘামতে শুরু করেন।

 

        ওনার স্ত্রী শাকেরাকে ফোন করেন এটা জানার জন্য যে সাজিদ অন্য দিনের মত যথাসময়ে স্কুলের দিকে গিয়েছে নাকি অন্য কোথায় গিয়েছে! এমনও তো হতে পারে যে সাজিদ তার বন্ধুর ওখানে আছে; অথবা সে আজ স্কুলেই যায়নি, বাসাতেই আছে! শাকেরা রান্নাঘরে ছিলেন বলে ফোনটা ধরতে একটু দেরী হয়-

 

- হ্যালো!

- সাজিদ কোথায়?

- কোথায় মানে? সে তো স্কুলে!

- না, সে স্কুলে নেই!

- তুমি কি করে জানলে?

- আমি একটু আগে ফোন করেছি। অফিস থেকে বলা হয়েছে যে সাজিদ আজ স্কুলে যায়নি!

- স্কুলে যায়নি তো কোথায় গিয়েছে? আজ আসুক সে তাকে ইচ্ছেমত না পিটালে তার শিক্ষা হবে না!

- শোনো! একটু আগে আমার কাছে একটি কল এসেছিল। একটি লোক বলল যে সাজিদকে নাকি অপহরণ করা হয়েছে!

- ইয়া আল্লাহ্‌! ও সাজিদের বাপ! এটা কি বললা?

- আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি। তাইতো নিশ্চিত হবার জন্য প্রথমে স্কুলে তারপর তোমাকে ফোন করেছি!

- এখন কি হবে আমাদের? আমার সাজিদের কি হবে? ইয়া আল্লাহ্‌ আমার সাজিদকে বাঁচাও!

- শোনো! এখন এতো অস্থির হয়ে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না! আমি বাসায় আসছি। এসে ঠিক করব কি করা যায়!

- ফোনে কি আর কিছু বলল? মানে কেন অপহরণ করল? কি চায় ইত্যাদি!

- না, সেসব কিছুই বলেনি। তবে বলেছে যে একটু পরে আবার ফোন করবে!

- আচ্ছা তুমি তাড়াতাড়ি আসো! আমার কিছুই ভালো লাগছে না!

- আসছি! আল্লাহ্‌ হাফেজ!

 

        বুলেট ট্রেনের গতিতে আমজাদ বাসায় পৌঁছে যান। শাকেরা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির। কিছুক্ষণ পরপর পাগলের মত প্রলাপ বকছেন আর সাজিদ সাজিদ করছেন! সাজিদ তাদের একমাত্র সন্তান। ছোট এ সংসারে কোনওমতে দিনাতিপাত করছেন ওনারা। বলাই বাহুল্য যে আমজাদ সাহেবের এই সামর্থ্য নেই যে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ছেলেকে ফিরিয়ে আনবেন। যদিও ওনারা এখনও জানেন না অপহরণকারীদের আসল উদ্দেশ্য কি! তবে আমজাদ সাহেব মোটামুটি নিশ্চিত যে মুক্তিপণ আদায় করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য!

 

        কিছুক্ষণ পর আবারো সেই নাম্বার থেকে ফোন আসে! আমজাদ কথা বলার জন্য হ্যালো বলতে না বলতেই অপর প্রান্ত থেকে সাজিদের কান্নার স্বর ভেসে আসে। সাজিদের কান্না শুনে আমজাদ বুঝতে পারে যে অপহরণকারী সত্য কথাই বলছে যে সাজিদ তাদের কাছেই আছে। আমজাদ কিছু বলার আগেই লোকটি বলে-


- যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনুন! আপনার ছেলেকে যদি জীবিত দেখতে চান তবে দশ লাখ টাকা লাগবে।

- আমি একজন সাধারণ কেরানি! আমি এতো টাকা কোথায় পাব?

- সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আগামী দুই দিনের মধ্যেই টাকা যোগাড় করে রাখবেন। আমি সময়মত আবারো ফোন করে টাকা হস্তান্তর করার স্থান এবং সময় জানিয়ে দেব।

- প্লিজ! আপনার পায়ে পড়ি! আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন!

- আর একটা কথা! যদি ভুলেও পুলিশের কাছে যান, তবে আপনার ছেলের লাশও পাবেন না!

 

        আমজাদ এবং শাকেরা চোখে অন্ধকার দেখছেন। ওনাদের মনে হচ্ছে কেউ যেন শক্ত করে চোখে কালো কাপড় বেঁধে দিয়েছে! আমজাদ একবার পুলিশকে জানানোর কথা ভাবে, আবার টাকা যোগাড় করার কথা ভাবে! শাকেরা যখন জানতে পেরেছে যে পুলিশের কাছে গেলে সাজিদের প্রাণের ঝুঁকি আছে, তখন তিনিও সেই চিন্তা মন থেকে বাদ দেয়ার কথা বলেন।

 

        আমজাদের কাছে এতো টাকা নেই; ওনার এমন পরিচিত ধনী বন্ধু বান্ধবও নেই যার কাছ থেকে টাকা ধার নেবে। তাছাড়া, কারো কাছে টাকা থাকলেও কেউ কি এতগুলো টাকা একসাথে দেবে তাকে?

 

        মাত্র দুই দিনের মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়াও সম্ভব নয়! আমজাদ আর শাকেরার মাথায় কোনও সমাধান আসে না। এদিকে সময় ঝরনার মত বয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। অবশেষে পরিচিত আত্মীয় স্বজনদের সাথে কথা বলে যার কাছ থেকে যত পান, তাই যোগাড় করতে থাকেন। কেউ দিয়েছেন দশ হাজার, কেউ বিশ হাজার- এমন করে যখন সব টাকা গুনে দেখা হয় তখন টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র এক লাখ বিশ হাজার টাকা!

 

        এই টাকা দিয়ে তো কিছুই হবে না! শাকেরা ওনার সামান্য যা গহনা ছিল সেগুলো বন্ধক দিয়েও খুব বেশী টাকা পাননি। পেয়েছেন মাত্র নব্বই হাজার টাকা! অপহরণকারীদের দাবী দশ লাখ টাকা; কিন্তু টাকা যোগাড় হয়েছে মাত্র দুই লাখ দশ হাজার টাকা!

 

        আমজাদ সিদ্ধান্ত নেন যে সেই নাম্বারে একটা ফোন করে তাকে অনুরোধ করবেন যাতে দুই লাখ দশ হাজার টাকা নিয়ে সাজিদকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ফোন বন্ধ! দেখতে দেখতে দুই দিন শেষ হয়ে যায়। আমজাদের অপেক্ষার পালাও শেষ হয়। ওনার ফোন বেজে ওঠে; এখন আরেকটি নাম্বার থেকে ফোন করা হয়-

 

- টাকা যোগাড় করেছেন?

- আমিতো আগেও আপনাকে বলেছিলাম যে এতো টাকা দেয়া আমার দ্বারা সম্ভব নয়।

- এসব কথা তো আমি শুনতে চাই না!

- অনেক কষ্টে আমি দুই লাখ দশ হাজার টাকা যোগাড় করেছি। প্লিজ এই টাকাটা নিয়ে আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন। ছেলের চিন্তায় ওর মাও মৃত্যুপথযাত্রী! আমাদের উপর একটু দয়া করেন! 

 

        ঠিক তখনই ফোনের লাইনটা কেটে যায়। আমজাদ এরপর অনেকবার ঐ দুটি নাম্বারে ফোন করার চেষ্টা করেও কোনও লাভ হয়নি। সেগুলো বন্ধই আছে। শাকেরা স্ট্রোক করেছে; হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী। আমজাদ দিন রাত নামাজ পড়ে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করছেন যাতে সাজিদ তাদের কোলে ফিরে আসে। দিন গড়িয়ে মাস যায়; মাস গড়িয়ে বছর; কিন্তু সাজিদের দেখা আর মেলে না!


আশ্চর্যজনকভাবে তিন বছর পর সেই দুটি নাম্বারের একটি থেকে আমজাদের ফোনে কল আসে! আমজাদ নাম্বারটি চিনতে পারেন! তিনি উত্তেজিতভাবে ফোনটি রিসিভ করে হ্যালো বলেন। অপর প্রান্ত থেকে শুধু নিঃশ্বাসের শব্দই কানে আসে কয়েক সেকেন্ডের মত; তারপর ফোনটি কেটে যায়!

 

 

View kingofwords's Full Portfolio
tags: